গণপরিষদে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা'র উগ্র-বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

Indigenous people culture and lifestyle
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৭০-৭৫
সাল পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হিসেবে
দুই দফা দায়িত্ব পালন করেছেন। এর
মাঝে প্রথম দফায় ১৯৭২ সালে তিনি
গণপরিষদের সদস্য হিসেবে
সংবিধান প্রণেতার ভূমিকা এবং
দ্বিতীয় দফায় ১৯৭৩ সালের
নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত প্রথম
জাতীয় সংসদে সদস্য হিসেবে
ভূমিকা পালন করেন। খুবই সংক্ষিপ্ত
মেয়াদের হলেও জনপ্রতিনিধি
হিসেবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার
ভূমিকার তাৎপর্য বিশাল।
প্রথমত, মানবেন্দ্র লারমা সর্বদাই
পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের বিশেষ
ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং স্বাতন্ত্র
ও মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ের
প্রাণপুরুষের ভূমিকা পালন করছেন,
জীবনভর। তারই অংশ হিসেবে
গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদে তার
সক্রিয়তা ছিল বিরামহীন। কিন্তু
এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা
গণপরিষদের সদস্য হিসেবে এবং
পরবর্তীতে সংসদ সদস্য হিসেবে
বাংলাদেশের আপামর
জনসাধারণকেও সত্যিকার অর্থেই
প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
জনসাধারণের আইনী অধিকার,
অর্থনৈতিক অধিকার, নারীর
অধিকার, দরিদ্র-বিপন্ন-দুস্থ মানুষের
অধিকার, শিক্ষার অধিকারসহ সকল
প্রকার অধিকার রক্ষায় তিনি যে
কতটা সোচ্চার ছিলেন, তা এই দুই
পরিষদে তার বক্তৃতাগুলোর দিকে
তাকালে বোঝা যাবে। তিনি সেই
বিরল ব্যতিক্রমদের মাঝে অন্যতম,
সংবিধান প্রণয়নের সময়টিতে
গণপরিষদের ৪০৩ জন সদস্যের মাঝে
কেবলমাত্র তিনি এবং সুরঞ্জিত
সেনগুপ্ত জনগণের নানান অধিকার
রক্ষার পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা
রেখেছিলেন। পরবর্তী সংসদেও
তিনি সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন
স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত,
পরবর্তীতে জাসদ এবং বাসদের
পদত্যাগী নেতা আবদুল্লাহ
সরকারকে। আমরা এখানে গণপরিষদ
সদস্য হিসেবেই মানবেন্দ্র নারায়ণ
লারমার ভূমিকাকে কিছুটা
মূল্যায়নের চেষ্টা করবো। সংসদে
আবদুল্লাহ সরকার ও এমএন লারমার
ভূমিকা নিয়ে পৃথক একটি গ্রন্থ রচিত
হতে পারে।
ফাইল ছবি


ক.
১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল গণপরিষদ
সদস্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম
জনসংহতি সমিতির আহবায়ক
হিসেবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা
‘বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন
কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের
জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার
দাবির আবেদনপত্র’ শীর্ষক একটি
‘আবেদনপত্র’ পেশ করেন। সেখানে
বলা হয়:
“ জনগণের অধিকার সংরক্ষণের
ব্যাপারে শাসন ব্যবস্থা ব্যতীত
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের
জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ করা
যাবে না। এই জন্যই আমরা “চারটি
বিষয়” উত্থাপন করে নিজস্ব আইন
পরিষদ সম্বলিত একটি আঞ্চলিক
স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেছি।
সুতরাং-
ক)   আমরা গণতান্ত্রিক শাসন
ব্যবস্থা সমেত পৃথক অঞ্চল হিসেবে
পার্বত্য চট্টগ্রামকে পেতে চাই।
খ)    আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের
জনগণের অধিকার থাকবে, এরকম
শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন চাই।
গ)    আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব
সংরক্ষিত হবে এমন শাসন ব্যবস্থার
প্রবর্তন চাই।
ঘ)    আমাদের জমি স্বত্ব-- জুম চাষের
জমি ও কর্ষণযোগ্য সমতল জমির স্বত্ব
সংরক্ষিত হয় এমন শাসন ব্যবস্থা
আমরা পেতে চাই।
ঙ)    বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল
হতে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন
কেহ বসতি স্থাপন করতে না পারে
তজ্জন্য শাসনতান্ত্রিক
বিধিব্যবস্থার প্রবর্তন চাই। ”
পরবর্তীতে এই দাবিগুলো নিয়ে
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা
গণপরিষদেও তার অবস্থানকে
দৃঢ়ভাবে বজায় রেখেছিলেন।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের
জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের
অধিকাংশ অধিবেশন ছিল প্রায়
বিতর্কবিহীন। স্বতন্ত্র সদস্য
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও ন্যাপ
(মোজাফফর) সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
সামান্য কিছু বিষয়ে সেখানে
বিতর্ক ও আলোচনা তুলতে সক্ষম হন।
এর অন্যতম একটি বিখ্যাত
আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশের
বাসিন্দাদের নাগরিকত্ব নির্ধারণ।
খসড়া সংবিধানে নাগরিকত্ব
সম্পর্কিত প্রস্তাবে বলা ছিল:
“ নাগরিকত্ব ৫।
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের
দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত
হইবে। ”
কিন্তু গণপরিষদে আঃ রাজ্জাক
ভূঁইয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী এটি
সংশোধন করা হয়। নাগরিকত্ব
সম্পর্কিত এই গূরুত্বপূর্ণ অংশটি
গণপরিদের আলোচনা থেকে উদ্ধৃত
করা যাক:
জনাব আ: রাজ্জাক ভুইয়া আপনার
প্রস্তাব পেশ করুন।
জনাব আ: রাজ্জাক ভুইয়া: মাননীয়
স্পীকার সাহেব, আমি প্রস্তাব করছি
যে,
" সংবিধান-বিলের ৬ অনুচ্ছেদের
পরিবর্তে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি
সন্নিবেশ করা হোক;
"৬। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের
দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে;
বাংলাদেশের নাগরিক গণ বাঙালি
বলিয়া পরিচিত হইবেন।"
জনাব স্পীকার: পরিষদের সন্মুখে
জনাব আ: রাজ্জাক ভুইয়া প্রস্তাব
এনেছেন যে,
" সংবিধান-বিলের ৬ অনুচ্ছেদের
পরিবর্তে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি
সন্নিবেশ করা হোক;
"৬। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের
দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে;
বাংলাদেশের নাগরিক গণ বাঙালি
বলিয়া পরিচিত হইবেন।"
ড: কামাল হোসেন (আইন ও সংসদীয়
বিষযাবলী এবং সংবিধান-প্রণয়ন
মন্ত্রী): মাননীয় স্পীকার সাহেব, এই
সংশোধনী গ্রহনযোগ্য বলে আমি মনে
করি এবং এটা গ্রহণ করা যেতে
পারে।

ফাইল ছবি


জনাব স্পীকার: শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ
লারমা।
শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (পি.
ই. -২৯৯: পার্বত্য চট্রগ্রাম-১): মাননীয়
স্পীকার সাহেব, জনাব আ: রাজ্জাক
ভুইয়া সংশোধনী - প্রস্তাব এনেছেন
যে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ
'বাঙালি' বলে পরিচিত হবেন।
মাননীয় স্পীকার সাহেব, এব্যাপারে
আমার বক্তব্য হল, সংবিধান বিলে
আছে, "বাংলাদেশের নাগরিকত্ব
আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত
হইবে"; এর সংগে সুস্পষ্ট করে
বাংলাদেশের নাগরিকগণকে
'বাঙালি' বলে পরিচিত করবার জন্য
জনাব অ: রাজ্জাক ভূইয়াার প্রস্তাবে
আমার একটু আপত্তি আছে যে,
বাংলাদেশের নাগরিকত্বের যে
সংজ্ঞা, তাতে করে ভালভাবে
বিবেচনা করে তা যথোপযুক্তভাবে
গ্রহণ করা উচিৎ বলে মনে করি।
আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই
পার্বত্য চট্রগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ
ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে।
বাংলাদেশের বাংলা ভাষা
বাঙালিদের সংগে আমরা লেখাপড়াা
শিখে আসছি। বাংলাদেশের সংগে
আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সবদিক
দিয়েই আমরা একসংগে একযোগে
বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন
চাকমা। আমার বাপ, দাদা চৌদ্দ
পুরুষ-- কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি।
আমার সদস্য-সদস্যা ভাই বোনদের
কাছে আমার আবেদন, আমি জানি
না, আজ আমাদের এই সংবিধানে
আমাদেরকে কেন বাঙালি বলে
পরিচিত করতে চায়...


ফাইল ছবি

জনাব স্পীকার: আপনি কি বাঙালি
হতে চান না?
শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা:
মাননীয় স্পীকার সাহেব, আমাদিগকে
বাঙালি জাতি বলে কখনও বলা হয়
নাই। আমরা কোন দিনই নিজেদেরকে
বাঙালি বলে মনে করি নাই। আজ যদি
এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের
সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাশ
হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা
জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে।
আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা
আমাদেরকে বাংলাদেশী বলে মনে
করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।
জনাব স্পীকার: আপনি বসুন। Please
resume your seat.
শ্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত: মাননীয়
স্পীকার সাহেব, এ ব্যাপারে আমার
বক্তব্য হল, জনাব অ: রাজ্জাক ভুইয়া
সাহেব যে সংশোধনী এনেছেন, তাতে
মনে এ প্রশ্ন জাগে যে বাংলাদেশে
বাঙালি ছাড়া ভারতের কেউ বাস
করেছে। আমি শুধু বলতে চাই যে,
বাঙালি বলতে এইটুকু বোঝায় যে,
যারা বাংলা ভাষা বলে তাদেরকে
আমরা বাঙালি বলি।
জনাব স্পীকার: Please resume your
seat. . আপনি বসুন, আপনি বসুন। এখন
পরিষদের সামনে প্রশ্ন হচ্ছে..
(কণ্ঠধ্বনিতে সংশোধনীটি পাশ হয়ে
যায়)
শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (পি.
ই. -২৯৯: পার্বত্য চট্রগ্রাম-১): মাননীয়
স্পীকার আমাদের অধিকার সম্পূর্ণরূপে
খর্ব করে এই ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ
সংশোধিত আকারে গৃহীত হল। আমি এর
প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং
প্রতিবাদস্বরূপ আমি অনির্দিষ্ট সময়ের
জন্য পরিষদের বৈঠক বর্জন করছি।
[অতঃপর মাননীয় সদস্য পরিষদ কক্ষ
ত্যাগ করে চলে যান।] ”
(সূত্র:বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্ক,
খÐ ২ সংখ্যা ১৩, মঙ্গলবার, ৩১
ডিসেম্বর, ১৯৭২)
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে কথা
বলতে না দেয়া হলেও ওই
অধিবেশনেই এরপর সৈয়দ নজরুল
ইসলাম দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের
প্রতিটি নাগরিকই যে বাঙালি, সেই
বিষয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। পার্বত্য
চট্টগ্রামের অধিবাসীদের উন্নয়নের
অঙ্গীকারও তিনি সেই বক্তৃতায়
করেন বটে, কিন্তু পরের বছরের
সংসদেই দেখা যায় পার্বত্য
চট্টগ্রামে নতুন নতুন সেনানিবাস ও
সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কার্যালয়
বানাবার উদ্যোগ দিয়ে মানবেন্দ্র
নারায়ণ লারমাকে উদ্বেগ প্রকাশ
করতে হচ্ছে। পাহাড়ে লক্ষ লক্ষ
বাঙালিকে পাঠিয়ে পাহাড়িদের
সংখ্যালঘু করার হুমকি প্রদান করা
হচ্ছে। এমনকি আবদুল্লাহ সরকারের
স্মৃতিকথাতেও রাষ্ট্রের কর্ণধার
কর্তৃক পাহাড়ে বাঙালিদের ঠেলে
পাঠাবার জন্য ভূমিহীন মানুষের
তালিকা তৈরির কথা বলা হয়েছে।
নাগরিকত্ব বিষয়ক এই সংশোধনী
প্রস্তাবটি রাজ্জাক ভূইয়ার কোন
ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছিল না। একদিকে
যেমন আমরা ড. কামাল হোসেন,
সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ গুরুত্বপূর্ণ
ব্যক্তিদের এই প্রস্তাবের পক্ষে
দাঁড়াতে দেখছি, অন্যদিকে
আমাদের এককথাও স্মরণে রাখতে
হবে যে, ২২ মার্চ ১৯৭২ রাষ্ট্রপতি
কর্তৃক জারি করা বাংলাদেশ
গণপরিষদ সদস্য (সদস্যপদ বাতিল)
আদেশ, [কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি
(সিসেশন অব মেম্বারশিপ) অর্ডার
(পিও ন. ২৩ অব ১৯৭২)] নামের
আইনটির কারণে কোন দলীয় সদস্যের
এখতিয়ারই ছিল না দলের অনুমতি ও
অনুমোদন ছাড়া কোন প্রস্তাব বা
সংশোধনী তোলার। এই সংশোধনী
প্রস্তাব যে আওয়ামী লীগের
কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তেরই প্রতিফলন,
তা বোঝা যায় এটার পক্ষে
প্রভাবশালী নেতাদের বক্তব্য
উপস্থাপন, বিরোধীদের বক্তব্য
উত্থাপনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং
কণ্ঠভোটে তা পাশ হওয়া থেকে।
 এরপর ১৯৭২ সালের ২ নভেম্বর
মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা পার্বত্য
চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল
গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
প্রস্তাবে তিনি বলেন:
”৪৭ অনুচ্ছেদের পর নিন্মোক্ত নতুন
অনুচ্ছেদটি সংযোজন করা হোক:
৪৭ক। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি
উপজাতীয় অঞ্চল বিধায় উক্ত
অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক,
সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকারের
নিরাপত্তার জন্য উক্ত অঞ্চল
একেটি উপজাতীয় স্বায়ত্বশাসিত
অঞ্চল হইবে।”
এরপর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা
পার্বত্য চট্টগ্রাম বৃটিশ ও
পাকিস্তান আমলেও কিভাবে একটি
স্বতন্ত্র শাসন ব্যবস্থার অধিনস্ত
ছিল সেই আলোচনা তুলতে গেলে
স্পিকার তাকে বারংবার বাধা
দেন, বাধা দেন অন্যান্য সংসদ
সদস্যরা। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী
মানেেবন্দ্র নারায়ণ লারমার কথার
মাঝে দাঁড়িয়ে বলেন:
“ মাননীয় স্পিকার সাহেব, মাননীয়
সংসদ সদস্য আমাদের
জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তির প্রতি,
আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের
প্রতি অবৈধ ভাষায় কথা বক্তৃতা
করছেন। এখানে তিনি ৪৭ অনুচ্ছেদে
সংশোধনী এনে ৪৭ক নামে নতুন
অনুচ্ছেদ সংযোজনের যে প্রস্তাব
এনেছেন, সেটা বাংলাদেশের
সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হানবে
বলে মনে হয়। ৩০ লক্ষ শহীদের
আত্মাহুতির বদলে যে জাতীয়তাবাদ
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারই প্রতি
ষড়যন্ত্রমূলক এ বক্তব্য এবং... ”।
বোঝা যায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে
ঢাল করার বাণিজ্য যে নতুন নয়,
সেটা বোঝার জন্য এটুকু যথেষ্ট।
এরপর স্পিকার আবারও সময় নষ্ট
হচ্ছে বলে মানেেবন্দ্র নারায়ণ
লারমাকে থামিয়ে দেন। ড. কামাল
হোসেন এরপর দাঁড়িয়ে পার্বত্য
চট্টগ্রামবাসীর প্রতি বিবিধ
আশ্বাসপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন,
‘চার মূলনীতির ভিত্তিতে আমরা
শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে
যাচ্ছি।’ । কিন্তু মানবেন্দ্র নারায়ণ
লারমা এর আগেই নাররিকত্ব নিয়ে
প্রশ্ন যেমন তুলেছিলেন,
তেমনিভাবে এই আশ্বাসগুলোর
কার্যকারিতা নিয়েও যথাযথভাবেই
প্রশ্ন তুলছিলেন, কিন্তু স্পিকার
তাকে থামিয়ে দেন, নিজের ভূমিকা
ভুলে স্পিকার যে মন্তব্য করেন, তাও
চিন্তার উদ্রেক না করে পারে না:
“ মি. লারমা আপনি বসুন। আপনার
প্রস্তাবটিকে আমি বিধিবহির্ভূত
বলে ঘোষণা করছি। কারণ ইট ইজ
য়্যাগেইনসট দি বেসিক
প্রিন্সিপ্যাল অফ বেঙ্গলি
ন্যাশনালিজম। এটা জাতীয়
মূলনীতির বিরোধী। ”
এইভাবে নাগরিকত্ব এবং
পার্বত্যবাসীর অধিকারের অন্যতম
গূরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটিকে চাপা দেয়া হয়
সংবিধান রচনার সূচনাপর্বেই।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে
বারংবার বাধা দেয়া হলেও, বসে
পড়তে বাধ্য করা হলেও, এমনকি
অপমানসূচক কথার প্রতিবাদে তিনি
ওয়াক আউট করতে বাধ্য হলেও
ইতিহাস তাকে স্মরণ রাখবে
পার্বত্যবাসীর অধিকার রক্ষায় তার
এই অনমনীয় ভূমিকার জন্য।
খ.১.
সূচনাতেই যেটা বলা হয়েছে,
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কেবল
পার্বত্যবাসীর প্রতিনিধি হিসেবেই
ভূমকিা পালন করেননি জাতীয়
সংসদে। বরং সমগ্র বাংলাদেশর
মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার,
মর্যাদা ও আইনী অধিকার নিয়ে,
তাদের অন্ন-বস্র-বাসস্থানের
নিশ্চয়তা নিয়ে তিনি সোচ্চার
ছিলেন।  ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবরে
গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে
খসড়া সংবিধানটিকে প্রস্তাব
আকারে গণপরিষদে উত্থাপন করা
হয়। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির
সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এই খসড়া
সংবিধানটির বিভিন্ন দিক নিয়ে
জনমত যাচাই এর জন্য ৩০ অক্টোবর
পর্যন্ত সভা স্থগিত করার আহবান
জানান। তাকে সমর্থন করেন স্বতন্ত্র
সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।
তাদের মতে জনগণের মতামত গ্রহণের
জন্য এক সপ্তাহ মোটেই যথেষ্ট সময়
নয়। ‘মূল্যবান সময়ের অপচয়’ এড়াতে
একই সঙ্গে জনগণের মতামত গ্রহণ ও
সংসদে আলোচনা চালিয়ে যাবার
মত দেন আইনমন্ত্রী কামাল হোসেন।
কিন্তু মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা
তার প্রস্তাবে বলেন:
”এই বিল সম্বন্ধে শ্রী সুরঞ্জিত
সেনের একটি প্রস্তাব আছে যে,
জনমত যাচাইয়ের জন্য আক্টোবর
পর্যন্ত আলোচনা স্থগিত রাখা হোক
বা  সময় দেয়া হোক--এরই সমর্থনে
আমি আপনার মাধ্যমে আমার বক্তব্য
রাখছি যে, যদি আমরা আমাদের
সংবিধান এত তাড়াহুড়োর মধ্যে পাশ
করতে চাই বা আলোচনা না করে
পাশ করতে চাই, তাহলে এতে অবশ্যই
ভুল থেকে যাবে।”
 অক্টোবর একত্রিশ তারিখে
সংবিধান বিলটির তৃতীয় পাঠ
অনুষ্ঠিত হয়। এটা নভেম্বরের তিন
তারিখ পর্যন্ত চলে। এই চার দিনে
আরও ২১ ঘন্টা আলোচনা হয়
সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিয়ে। মোট
১৬৩ টি সংশোধনী প্রস্তাব
উত্থাপিত হয়। এর মাঝে ৭০ টি
প্রস্তাব উত্থাপন করেন ন্যাপ দলীয়
সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ২৫টি
প্রস্তাব উত্থাপন করেন মানবেন্দ্র
নারায়ণ লারমা। বাকি যে
প্রস্তাবগুলো আওয়ামী লীগের
সদস্যরা তুলেছিলেন, সেগুলো
প্রধানত ছিল ভাষাগত ত্রুটি ও
অন্যান্য খুটিনাটি প্রসঙ্গে। আজকেও
কেউ যদি বাংলাদেশের সংবিধানের
অগণতান্ত্রিক, জাতিদ্বেষী ও
স্বৈরতন্ত্রী অনুচ্ছেদগুলোর তালিকা
প্রণয়ন করতে চান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
আর মানবেন্দ্র লারমা কর্তৃক উত্থাপিত
সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর দিকে নজর
বোলানোই তার জন্য অনেকটাই যথেষ্ট
হবে। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আজ
বেঁচে নেই, আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
আজ অকাতরে সাম্প্রদায়িক পঞ্চদশ
সংশোধনীকে ‘প্রাগমেটিক’ বলে
ফতোয়া দিচ্ছেন। সেই পুরনো
প্রবাদটিই স্মরণ করা যায়: মৃত্যুর
আগের মুহূর্ত পর্যন্ত
রাজনীতিবিদকে সততার পরীক্ষা
দিতে হয়।
অজস্র্র উদাহরণের মাঝে কয়েকটি
থেকেই বোঝা যাবে গণতান্ত্রিক
চেতনা রক্ষায় মানবেন্দ্র নারায়ণ
লারমার ভূমিকা। যেমন, প্রথম
থেকেই আওয়ামী লীগের লক্ষ ছিল
সংসদ সদস্যদের ক্ষমতাহীন করে
ফেলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংবিধান
প্রতিষ্ঠা। আগেই আলোচনা করা
হয়েছে, ২২ মার্চ ১৯৭২ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক
জারি করা ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য
(সদস্যপদ বাতিল) আদেশ’ নামের
আইনটির কারণে কোন দলীয় সদস্যের
পক্ষেই সম্ভব ছিল না দলের অনুমতি ও
অনুমোদন ছাড়া কোন প্রস্তাব বা
সংশোধনী তোলার। পৃথিবীতে একমাত্র
বাংলাদেশেই সংবিধান প্রণেতাদের
হাত-পা-মুখ এভাবে বেধে রাখা সম্ভব
হয়েছিল।
অন্যদিকে সংবিধানের  খসড়া
প্রস্তাবে ৭০ অনুচ্ছেদ যথেষ্ট
অগণতান্ত্রিক ছিল, জনগণের
নির্বাচিত প্রতিনিধিকে দল
বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নিলে তার
সংসদ সদস্যপদও চলে যাবার প্রস্তাব
ছিল এটি:
”রাজনৈতিক দল হইতে পদত্যাগ বা
বহিষ্কারজনিত কারণে আসন শূন্য
হওয়া
 ৭০(১) কোন রাজনৈতিক দলের
প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন
ব্যক্তি কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য
নির্বাচিত হইবার পর তিনি যদি উক্ত
দল হইতে পদত্যাগ করেন বা বহিষ্কৃত
হন, তাহা হইলে এই অনুচ্ছেদের (২)
দফার বিধানাবলী অনুযায়ী তাহার
আসন শূন্য হইবে।
(২) এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার
বিধানাবলী সাপেক্ষে কোন
রাজনৈতিক দলের সম্পাদকের নিকট
হইতে স্পীকার উক্ত দল হইতে কোন
সংসদ-সদস্যের পদত্যাগ বা
বহিষ্কারের ( শেষোক্ত ক্ষেত্রে
বহিষ্কারের কারণসহ) সার্টিফিকেট
প্রাপ্ত হইলে অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব
না করিয়া স্পীকার তাহা সরকারী
বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ করিবেন এবং
অনুরূপ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হইলে
উপরি-উক্ত ব্যবস্থা সাপেক্ষে
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত সদস্যের
আসন শূন্য হইবে।
(৩) এই অনুচ্ছেদের (২) দফা-অনুসারে
সরকারী বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পূর্বে
সংশ্লিষ্ট সদস্যকে স্পীকার উক্ত
সার্টিফিকেটের প্রতিলিপি প্রদান
করিবেন এবং যদি উক্ত সদস্য অনুরূপ
সার্টিফিকেট-প্রাপ্তির তিন দিনের
মধ্যে স্পীকারকে এই মর্মে নোটিশ
প্রদান করেন যে, তিনি এই
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (৪) দফার
অধীন উক্ত বিষয় নির্ধারণের জন্য
নির্বাচন কমিশনের নিকট আবেদন
করিতে ইচ্ছুক এবং যদি তিনি অনুরূপ
নোটিশ প্রদানের সাত দিনের মধ্যে
উক্ত আবেদনপত্র দাখিল করেন,
তাহা হইলে যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি
পদত্যাগ করিয়াছেন বা বৈধভাবে
দল হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছেন বলিয়া
নির্বাচন কমিশন স্থির না করেন,
ততক্ষন পর্যন্ত তিনি সংসদ-সদস্যপদে
বহাল থাকিবেন এবং স্পীকার
তদনুযায়ী সরকারী বিজ্ঞপ্তি
প্রকাশ স্থগিত রাখিবেন।”
কিন্তু গণপরিষদে খসড়া সংবিধান
বিষয়ক আলোচনায় এই প্রস্তাবিত ৭০
ধারায় ‘বহিষ্কারে ক্ষেত্রে কারণসহ’
এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বিষয়টি
স্থির করা পর্যন্ত কালক্ষেপনের সুযোগ
ছিল, সেই চক্ষুলজ্জাটুকু পর্যন্ত বাতিল
করা হয়, তারই সাথে যুক্ত করা হয় দলের
বিপক্ষে ভোট দিলেও তার সদস্যপদ
বাতিল করার বিধানটি। সংশোধনী
প্রস্তাবের পর চূড়ান্ত চেহারায় ৭০
অনুচ্ছেদ দাঁড়ায় এমন:
৭০। কোন নির্বাচনে কোন
রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে
মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-
সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি
(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন,
অথবা
(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে
ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে
তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি
সেই কারণে পরবর্তী কোন
নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার
অযোগ্য হইবেন না।
অর্থাৎ, খসড়া প্রস্তাবে ‘কারণ
দর্শানো’ ‘বৈধভাবে দল হইতে
বহিষ্কৃত হইয়াছেন বলিয়া নির্বাচন
কমিশন স্থির না করেন’ ইত্যাদি যে
সামান্য দ্বিধা ছিল, চূড়ান্ত
সংবিধানে তা ঝেড়ে ফেলে সাথে
এও যুক্ত করা হয় যে, এমনকি দলের
বিপক্ষে ভোট দিলেও সদস্যপদ চলে
যাবে। বলা যায়,  গণপরিষদ সদস্যদের
মুখে কুলুপ আঁটার জন্য যে সদস্যপদ
বাতিল আদেশটি ছিল, তার হুবহু
প্রতিলিপি আমরা ভবিষ্যতে সংসদ-
সদস্যদের জন্যও পেলাম। এভাবে
সংবিধান প্রণয়নকালীন রাষ্ট্রপতির
অগণতান্ত্রিক যে আদেশটি
গণপরিষদ সদস্যদের দলের দাসে
পরিনত করেছিল, সেটাই এবার
সংবিধানসম্মত হয়ে ভবিষ্যত সংসদ
সদস্যদেরও মুখবন্ধ করার ও দলীয়
স্বৈরতন্ত্রের অধীনে নিয়ে আসার
কাজটিও সম্পন্ন করল। গণপরিষদের
সদস্য (সদস্যপদ বাতিল) আদেশে
যেভাবে গণপরিষদের সদস্যদের
স্বাধীন মতপ্রকাশের এখ্তিয়ারকে
বিনষ্ট করা হয়েছিল, তারই
ধারাবাহিকতা সংসদেও অব্যাহত
রাখার বন্দোবস্ত এভাবেই সম্পন্ন
হলো, ্ওয়েস্টমিনিস্টার ধাঁচের
সংসদের একটা প্রহসন জাতি উপহার
পেল।
এই সংশোধনীর প্রতিবাদ করেন
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্র
নারায়ণ লারমা। এমনিভাবেই
সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও মানবেন্দ্র
লারমা জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা,
মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ আরও
কিছু বিষয়ে সংবিধানকে কিছুটা
গণতান্ত্রিক করার সংশোধনী
প্রস্তাব তোলেন; সেগুলো সবই
প্রত্যাখ্যাত হয়। অন্য কোন সদস্যই
এমন কোন প্রস্তাব হাজির করেননি।
এরা দুজন খসড়া সংবিধানের ৩২, ৩৭,
৩৮, ৩৯, ৪১, ৪৭, ৬৬, ৭০, ১৩৫ ধারার
অগণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে
ধরে তার সংশোধনী প্রস্তাব হাজির
করেন। সবগুলো প্রস্তাবই কণ্ঠভোটে
নাকচ হয়ে যায়। সেটাই স্বাভাবিকও
ছিল, কারণ এই সংশোধনী
প্রস্তাবগুলো সমর্থন করলে সেই
নির্দিষ্ট সদস্যের সদস্যপদ বাতিল
হয়ে যেতো। স্থানাভাবে দৃষ্টান্ত
হিসেবে এখানে আমরা ৩২
অনুচ্ছেদের ওপর মানবেন্দ্র নারায়ণ
লারমার সংশোধনী প্রস্তাবের কিছু
অংশ তুলে ধরছি:
খসড়া সংবিধানে ৩২ অনুচ্ছেদ
অনুযায়ী
জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার
রক্ষণ, গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে
রক্ষাকবচ
৩২। আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও
ব্যক্তি-স্বাধীনতা হতে কোন
ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না।
শ্রী লারমা: জনাব স্পীকার সাহেব,
এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমার
বক্তব্য হলো, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত’
শব্দাবলী যদি এই অনুচ্ছেদে রাখা হয়
এবং সেটা যদি এই পরিষদে গৃহীত হয়ে
যায়, তাহলে আগামীতে যারা আইন
পরিষদে আসবেন, তারা যদি
‘আইনানুযায়ী ব্যতীত’ শব্দাবলীর
মাধ্যমে ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যান,
তাহলে জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার
অধিকার রক্ষার জন্য এই যে ৩২
অনুচ্ছেদটি করা হয়েছে, সেই
অনুচ্ছেদের কোন অর্থ থাকবে না।  তার
কারণ, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার
অধিকার রক্ষার জন্য ‘আইনানুযায়ী
ব্যতীত’-- এই শব্দাবলীর মাধ্যমে
ক্ষমতার দ্বারা এমন এমন আইন গৃহীত হতে
পারে, যার দ্বারা জীবন ও ব্যক্তি-
স্বাধীনতার অধিকার খর্ব হয়ে যাবে।
এখন আমাদের এখানে পাবলিক
সেফটি আইন নাই, কিন্তু এই অনুচ্ছেদ
দ্বারা তা প্রণয়ন করা যাবে যে
কোন সময়ে এবং এই অনুচ্ছেদ যদি
এইভাবে গৃহীত হয়ে যায় এবং
ভবিষ্যতে যদি এই ‘আইনানুযায়ী
ব্যতীত’ শব্দাবলীর দ্বারা জীবন ও
ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করার আইন
বলবৎ হয়, তাহলে জীবন ও ব্যক্তি-
স্বাধীনতার অধিকার রক্ষার
ব্যাপারে কোন সুযোগ থাকবে না।
অর্থাৎ মানুষের নাগরিক জীবনের
যে স্বাধীনতা, স্বীয় বিবেক-বুদ্ধি
নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য যে
অভিব্যক্তি, তা সম্পূর্ণরূপে খর্ব হয়ে
যাবে।
তাই আমি এই অনুচ্ছেদে ‘আইনানুযায়ী
ব্যতীত’ শব্দগুলির পরিবর্তে ‘আদালতের
অনুমোদন’ শব্দাবলী সন্নিবেশিত করার
প্রস্তাব করছি। আদালতের কাছে যদি
আমাদের জীবন ও ব্যক্তি
স্বাধীনতার অধিকার রক্ষার এই
রক্ষাকবচ দেওয়া হয়, তাহলে
আমাদের যে স্বাধীনতা, তা নিশ্চয়ই
সংরক্ষিত হবে।
(প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যায়)
মানবেন্দ্র লারমার এই আশঙ্কা
সত্যমূলক ছিল, অচিরেই ১৯৭৩ সালের
দ্বিতীয় সংশোধনীতে ‘জীবন ও
ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ,
গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ’
অংশেরই ৩৩ অনুচ্ছেদে আদালতের
অনুমোদন ছাড়াই নিবর্তনমূলক অন্তরীণ
রাখার ব্যবস্থা সম্বলিত দফা যুক্ত করা
হল, তারই সাথে জরুরি অবস্থা জারির
বিধান ও জরুরি অবস্থার সময়ে সকল
মৌলিক অধিকার স্থগিতের বিধান
সম্বলিত অংশও গৃহীত হলো।
খ.২.
একইভাবে এই দুই সদস্য বাক
স্বাধীনতা নিয়েও আলোচনা করেন,
যদিও তাতে কর্ণপাত করা হয়নি
মোটেই, এমনকি তারা সংবিধানের
এই ধারাগুলোর সাথে
পাকিস্তানেরই মিলগুলোও দেখিয়ে
দেন, যেমন মানবেন্দ্র নারায়ণ ৩৯
অনুচ্ছেদ সম্পর্কে সংশোধনী
প্রস্তাব দিয়ে বলেন:
সংবিধান বিলের ৩৯ অনুচ্ছেদের ১ম
দফায় রয়েছে:
(১) চিন্তা ও বিবেকের
স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।
তারপর ২য় দফায় রয়েছে:
(২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা,
বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা,
শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে
কিংবা আদালত-অবমাননা,
মানহানি  বা অপরাধ সংঘটনে
প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা
আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ
সাপেক্ষেÑ
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব
প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের;
এবং
(খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার
নিশ্চয়তা দান করা হল।
 এখানে আমি বলতে চাচ্ছি, সেটা
হল, বাকস্বাধীনতা, ভাব-প্রকাশের
স্বাধীনতা শর্তহীন হতে হবে।
সংবাদপত্র-জগতের স্বাধীনতা বা
চিন্তা জগতের স্বাধীনতার
নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু
এই অধিকার আবার এক দিক দিয়ে
খর্ব করা হয়েছে। যেমন- রাষ্ট্রের
নিরাপত্তার খাতিরে আমার বাক
স্বাধীনতা থাকবে না। বিদেশী
রাষ্ট্রের সম্পর্কে বন্ধুত্বপূর্ণ কোন
রকম উক্তি করার ব্যাপারে আমার
বাক-স্বাধীনতা থাকবে না।
জনশৃঙ্খলার নামে আমার বাক-
স্বাধীনতা থাকবে না। শালীনতা বা
নৈতিকতার স্বার্থে যদি কোন প্রশ্ন
তোলা হয়, তাহলে আমার বাক
স্বাধীনতা থাকবে না।
মাননীয় স্পীকার সাহেব, এখানে
বাক-স্বাধীনতা ও
ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপারে
কিছুটা সন্দেহের অবকাম রয়েছে।
অতীতের ইতিহাস যদি আমরা দেখি,
তাহলে জানা যাবে যে, স্বৈরাচারী
আইয়ুব সরকারও এ রকমভাবে রাষ্ট্রের
নিরাপত্তার নামে, জনশৃঙ্খলার নামে,
বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ
সম্পর্কের নামে, মানহানির নামে,
আদালত অবমাননার নামে এদেশের
জনসাধারণের এবং জনপ্রতিনিধিদের
অধিকার খর্ব করেছিল।
এই পরিষদের মাননীয় সদস্যবৃন্দ এর
অনেকেই রয়েছেন, যাদের
অভিজ্ঞতা রয়েছে তথাকথিত
পাকিস্তানের স্বৈরাচারী মুসলিম
লীগ সরকার, স্বৈরাচার আইয়ুব
সরকারের নির্যাতন সম্বন্ধে। এখানে
যেসব মাননীয় সদস্য রয়েছে, তাদের
অনেকেই সেই নির্যাতন ভোগ
করেছেন। এখানেও যদি সেই প্রশ্ন
তোলা হয়, তাহলে সংবাদপত্রের
অধিকার খর্ব হবে যেমন হয়েছিল
আইয়ুব সরকারের আমলে... (ইত্যাদি)
এর জবাবে গণপরিষদে আওয়ামী
লীগের একজন সদস্য জনাব নুরুল হক
যা বলেছিলেন, তার একাংশ উদ্ধৃত
করাটা আওয়ামী লীগের মনোভাব
বোঝাবার জন্য অনেকটাই যুৎসই হবে:
জনাব মো. নুরুল হক: ৩৯ অনুচ্ছেদে
চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা
দেওয়ার প্রশ্ন রয়েছে। সেখানে
কোন প্রকার বিধিনিষেধ দেওয়া হয়
নাই। বাক-স্বাধীনতা এবং
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে
কিছু বলতে গেলে প্রথমেই জানা
দরকার যে, সে স্বাধীনতা আমরা
দিয়েছি,  কিন্তু তার মানে
উচ্ছৃঙ্খলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া নয়।
বাক-স্বাধীনতা মানে লাইসেন্স নয়,
আদালতের অপমান করার অধিকার
নয়। নৈতিকতার বিরুদ্ধে, সমাজের
বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের নামে,
স্বাধীনতার নামে যা খুশি তাই করা
হবে, এইটা কোনদিন রাষ্ট্র সহ্য
করতে পারে না, আইনে সমর্থন করতে
পারে না। আজকে দেখছি, তিনি এই
রকম একটা সংশোধনী এনেছেন। সেই
মোতাবেক যদি এইটাকে বাদ
দেওয়া হয়, তাহলে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র
থাকবে না-- থাকবে বনতন্ত্র।
সেজন্য এই সংশোদনী আদৌ গ্রহণ
করা যায় না। আমি তাই অনুরোধ করব,
শ্রী লারমা এবং শ্রী সেনগুপ্ত যেন
এই ধরনের প্রস্তাব না আনেন।
(ভোটে লারমার সংশোধনী
প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যায়।)
১৯৭২ সালের সংবিধানকে তাই
মানবেন্দ্র লারমা গণতান্ত্রিক
সংবিধান হিসেবে মেনে নেননি।
সংবিধান প্রণয়নকারী গণপরিষদের
বক্তৃতায় তিনি বলেন “শাসনতন্ত্র
বিলের প্রতিটা ধারাই প্রমাণ দেয়
যে, একহাতে জনগণকে অধিকার
দেয়া হয়েছে, আবার অন্য হাতে সে
অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে।”
জাতিসত্তার স্বীকৃতি দাবি করে
তিনি বলেন:  “আমি সেই নির্যাতিত
ও নিপীড়িত জাতিসত্তার একজন। ...
আমরা বাংলাদেশের জনগণের সাথে
ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে বাঁচতে
চাই। কিন্তু আমাদের দাবি
আঞ্চলিক স্বায়ত্ত¡শাসনের। খসড়া
সংবিধানে আমাদের জাতিসত্তার
কথা নেই। এ কথা আমি শুধু আজ বলছি
না, ইয়াহিয়া আর আইয়ুব আমলেও
বলেছি। ... ’৫৬ ও ’৬২ সালের
শাসনতন্ত্রে জনগণের অধিকার
স্বীকৃত হয়নি। তাই জনগণ তা
প্রত্যাখ্যান করেছিল। স্বাধীন
বাংলাদেশের সংবিধান তৈরি
করার সময় আমাদের তা মনে রাখতে
হবে। সংবিধান এমন হতে হবে, যাতে
ভবিষ্যৎ বংশধরেরা তাকে গ্রহণ
করে।”
কিন্তু এভাবে সংবিধানের
অন্তসারশূন্যতা প্রতিপাদন করলেও
এতে তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন,
কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ
পরিস্থিতির দিকটি তাকে
বিবেচনায় রাখতে হয়েছিল। যে
কোন রকম অবাধ্যতার শাস্তি যে
ভয়াবহ হবে, সেটা শাসকদের নানান
কার্যকলাপে পরিস্কার ছিল।
অন্যদিকে সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত
সংবিধানের এই সকল অগণতান্ত্রিক
ও আইয়ুবী ধারার প্রতিবাদে তাতে
স্বাক্ষর করা থেকেই বিরত থাকেন।
গণপরিষদে মানবেন্দ্র নারায়ণ
লারমার বক্তৃতাগুলোতে বারংবার
পাওয়া যাবে নারীদের অধিকার
নিশ্চিত করতে সংবিধানের
ব্যর্থতার কথা, বাংলাদশের
শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের মৌলিক
অধিকার নিশ্চিত করতে
সংবিধানের ব্যর্থতার কথা। এই
বক্তৃতাগুলোতে সারল্য এবং
দৃঢ়চিত্ততার যে পরিচয় পাওয়া
যাবে, তা তুলনারহিত। এদের
অধিকারগুলার নিশ্চয়তার
অন্তভূক্তির চেষ্টা তিনি করেছেন।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা
বাংলাদেশের গণপরিষদে তার নিজ
জাতির স্বীকৃতি ও অধিকার আদায়
করতে ব্যর্থ হয়েছেন, যেমন ব্যর্থ
হয়েছেন বাংলাদেশের মানুষের
অধিকারের স্বীকৃতি, কাগুজে
আশ্বাসের বদলে নিশ্চয়তা আদায়
করতে। কিন্তু এটাও সত্যি যে,
ভবিষ্যতের ইতিহাসে মানবেন্দ্র
নারায়ণ লারমার নাম বারংবার
ফিরে ফিরে আসবে তার সেই
অবিস্মরণীয় চেষ্টাটুকুর জন্যই। তিনি
শুধু পার্বত্যবাসীর নায়ক নন,
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল
নিপীড়িত মানুষের মুক্তিরও
স্বপ্নদর্শী।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে
জানাই অশেষ শ্রদ্ধা।

Comments

Popular posts from this blog

আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র

প্রসঙ্গ জাতীয়তাবাদঃ তুষার শুভ্র তুলু

আদিবাসী অধিকার কি,এগুলো কোথায় পাবো ?