কাপ্তাই লেকে ডুবে যাওয়া করুনাময় চাকমার আত্মকথন,রুপকারী মারিশ্যা।

নীচের সেই ঝগড়াবিল আদাম :


বর্তমানে রাংগামাটির যে পর্যটন মোটেলটি আছে তার ঠিক পূর্ব দক্ষিণ বরাবর কাপ্তার লেকের যে পানি দেখা যায় ঠিক সেইখানে পানির তলে ডুবে আছে আমাদের ‘ঝগড়াবিল আদাম’। আজো চোখ বন্ধ করলে আমি যে গ্রামে এখনো ফিরে যায় সে গ্রাম আমার পানিতে ডুবে যাওয়া গ্রাম ‘ঝগড়াবিল আদাম’। কাপ্তাই বাধ নির্মাণ পূর্বের আমাদের আদি আবাস,১০৪ নম্বর ঝগড়াবিল মৌজা, রাংগামাটি। রাংগামাটি শহর থেকে মাত্র ৫ মাইল দক্ষিনে আমাদের এই গ্রাম। বর্তমানের তবলছড়ি বাজারও তখন ছিল আমাদের এই ঝগড়াবিল মৌজার অর্ন্তভুক্ত। ঝগড়াবিল নামকরণের একটা ‘কাহিনী’ আছে। আমাদের এই জায়গায় একটি বিশাল বিল ছিল। আর বিশাল বিল ভর্তি ছিল মাছ। বিলের আশ পাশের গ্রামের লোকজন মাছ ধরতে এসে শুধুই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করত। এই থেকেই এই বিলের নাম হয়ে গেল ‘ঝগড়াবিল’।


তবে বালুখালি মৌজার অধীনে ঝগড়া বিলের পরে আরেকটা বিল ছিল ‘পদ্ম বিল’। এই পদ্ম বিল ঝগড়া বিল এর চেয়ে অনেক বড়। দুই বিলের মধ্যবর্তী উর্বর জায়গায় ধীরে ধীরে মানুষের বসতি গড়ে উঠলে গ্রামের পত্তন ঘটে। তারমধ্যে বালুখালি আদাম, হোনা তুলি আদাম অন্যতম। আর পদ্মবিলের আশপাশেও আমাদের মানে আমার বাবার অনেক জায়গা জমি ছিল। আমাদের ঝগড়াবিলের গ্রামে শুধু ‘ধামেই হজার’ চাকমা ছিলনা, অন্য ‘হজারও’ লোক ছিল। ছিল মগ তংচঙ্গ্যার আবাস। আর ১০০ ঘর এর বেশী বাঙালীর আবাস ছিল এই গ্রামে আর তারা সকলেই ছিল মসুলমান। বাঙালী মুসলমানরা ছিল জমিদার কামিনী দেওয়ান এর প্রজা। কামিনী বাবু এদেরকে নিজেদের জমিদারী কাজের জন্য চট্টগ্রামের শরৎবাধা কাউকালী শিলকছড়ি থেকে এনেছিলেন। কামিনী বাবু তাদেরকে দিয়ে জায়গা জমি ভেঙ্গে জমিদারী পত্তন করেন এবং কিছু জায়গা বাঙালী মুসলমানদের দিয়ে দেন, তবে তিনি বছর শেষে এসব জায়গার খাজনা এসে নিয়ে যেতেন। বাঙালী মুসলমানদের বাড়ী আর আমার বাড়ী ছিল পাশাপাশি তা সত্বেও আমাদের মাঝে সর্ম্পক নিয়ে কোন টেনশন ছিলনা। আর্দশ গ্রাম বলতে যা বুঝায় তাই ছিল আমাদের গ্রাম।


এই গ্রামে একট বৌদ্ধ মন্দির ছিল। ‘ঝগড়াবিল বৌদ্ধ মন্দির। এখন যেভাবে গ্রামে গ্রামে বৌদ্ধ মন্দির দেখা যায় তখনকার সময়ে এত বৌদ্ধ মন্দির ছিলনা। আমাদের এলাকায় শুধু মাত্র এই বৌদ্ধ মন্দিরটি ছিল। তখনকার মানুষ প্রকৃতিকে পূজা করত। আমার মনে আছে যে বছর আমাদের গ্রাম ছেড়ে যেতে হয় সেই বছরই আমরা ধুমমাম করে বৌদ্ধ ধর্মের আড়াই হাজার বর্ষপূর্তি উদযাপন করেছিলাম। সেই মেলার আয়োজন কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আমি দায়িত্বে ছিলাম। আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামের কমুদ বাবুর কাছে বৌদ্ধ ধাতু ছিল, সেই বৌদ্ধ ধাতু এনেছিলাম এই মেলায়। তিন দিন ধরে মেলা চলাকালীন সময়ে কত ধরণের খেলা চলেছিল। হাউজি খেলার বিপরীতে আমরা নিজেরা একটি যাত্রা পালা করেছিলাম। সবাই আমরা জানতাম আমাদের এটাই শেষ উৎসব এই গ্রামে তবুও ধুমধামের আর উৎসাহের কোন কমতি ছিলনা।


এই গ্রামে একটি ‘ইমি স্কুল’ ছিল। এই স্কুল ক্লাশ সিক্স পর্যন্ত পড়ানো হত। এরপরে রাংগামাটিতে গিয়ে পড়তে হত। ক্লাশ ওয়ান থেকে ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত হচ্ছে প্রাইমারী সেকশন, আর ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত হচ্ছে সেকেন্ডারী সেকশন। এই গ্রামের ইমি স্কুলটি আমরাই প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। এর আগে প্রাইমারী শিক্ষার জন্য না হয় রাংগামাটি যেতে হত, না হয় বাড়ীতে গৃহ শিক্ষক রেখে পড়াতে হত।


কর্নফুলির নদীর পারেই গড়ে উঠেছিল ‘ঝগড়াবিল আদাম। উর্বরা ভূমি বলতে যা বুঝায় তাই ছিল এই গ্রামের মাটি। সারা বছর নদীর পার জুড়ে সবজি চাষ হতো। সর্ষে, মরিচ নানা ধরণের সবজি কিনা হতো সেই পার জুড়ে। মরিচ পাকা শুরু হলে শুধু দেখা যেতো লালে লাল হয়ে আছে নদীর দুই পার। আর সর্ষের ফুলের সময়। যেদিকে চোখ যায় শুধু চিকচিক করা হলুদ আর হলুদ। আর হতো আখ। এত্তো বড় বড় আখ হতো। সে আখের রস থেকে আখগুড় বানানো হতো। আখ চাষ করার সময় আখের খেতের ভিতরে আমরা হলুদ লাগাতাম। বিশাল বিশাল হলুদ যখন মাটি খুড়ে বের করতাম চোখ মন আনন্দে ভরে যেত। মনে আছে আমার তখন হলুদের দাম ছিল মণে ৩(তিন) টাকা। তবে কোন একবছর সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আখের গুড় খুব দামে বিক্রি করেছিলাম আমরা মণ প্রতি ২৫(পচিঁশ) টাকা করে। আর মরিচের দাম ছিল মণ প্রতি ৮০(আশি)টাকা করে। তবে সেসময়ে এমনিতে এর থেকে কমদামে বিক্রি হতো।

ধামেই হজা কাংখং গোষ্ঠীর গোড়া পত্তন :

আমরা ‘ধামেই হজার কাংখং’গোষ্ঠির বংশধর। বাবার কাছে শুনেছি, এই গোষ্ঠীর মীননাথ আর সিংহনাথ নামে দুই ভাই ছিলেন এবং তারা এই এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করেন। তবে তাদেরকে সকলেই ‘উত্তয্যে পাকসা’বলত। কিন্তু এই দুই ভাই কোথা থেকে এসেছিলেন সেটা কারোর জানা নেই। এমনকি বাবাও জানতেন না।

আমার বাবা ছিলেন জাঁদরেল পুলিশ অফিসার। নাম শুম্ভমুনি চাকমা। মায়ের নাম হেমাঙ্গীনি চাকমা। আমরা দুই ভাই এক বোন। আমাদের আদি নিবাস রাংগামাটিতে হলেও বাবার চাকুরীর কারণে আমার জন্ম হয় দিঘীনালায়, খাগড়াছড়িতে। বাবা চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পর আমরা আমাদের আদি গ্রামে ফিরে আসি। অবশ্য আমাদের সাথে গ্রামের মানুষের সর্ম্পক সবসময় ছিল। আমার জন্ম ১৯২৮ সালে। তবে কোন মাসে তা জানিনা। সে হিসাবে আমার বয়স এখন ৮৬ বছর। বাবা মা আমার নাম রাখেন করুনাময় চাকমা। কাপ্তাই বাধের সেই প্রজন্মের মধ্যে হতে পারে আমিই শেষ ব্যাক্তি। আমি লেখাপড়া শিখিনি তেমন। তবে আমার বড় ভাই জ্যোর্তিময় চাকমা লেখাপড়া শিখেছেন, ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হয়েছেন। তাই তিনি রাংগামাটি শহরেই রয়ে যান। কিন্তু বাবার অবসর নেওয়ার পরপরই আমি বাবার সাথে গ্রামেই ফিরে এসেছিলাম।

বাবা অবসর নেওয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিশাল মাটির ঘরে চাকমা ভাষায় আমরা বলি গুদাম ঘর সেখানে এসে উঠেন। এখানেই বাবার অবসর জীবন শুরু হয়। কিছু সময়ের পরে আমার মা এই গ্রামেই মারা যান। গ্রামে প্রায় সকলের যৌথ পরিবার থাকলেও আমরা একক পরিবার ছিলাম। তবে আমাদের সাথে আমার এতিম জেঠাতো ভাই গোপালকৃঞ্চ চাকমা থাকতেন। এই ভাইয়ের নিজের বলতে কেউ ছিলনা। যদিও আমার বিয়ের পরপরই তিনি আলাদা হয়ে যান। মাত্র ১৭ বছর বয়সে আমি বিয়ে করি। চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পরেও বাবার দুটো লাইসেন্স করা বন্দুক ছিল। অবশ্য তখন প্রায় প্রত্যেকের ঘরে ঘরে বন্দুক থাকত। নিজেদের প্রয়োজনে, শিকারের প্রয়োজনে সবাই বন্দুক রাখতেন ঘরে। এইসব বন্দুক দিয়ে কাউকে মারা তখন ভাবাই যেতোনা। খুব স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন আর শান্তির জীবন বলতে যা বুঝায় তাই ছিল আমাদের সেই পুরোনো জীবন। রাংগামাটি শহর খুব কাছে হওয়াতে আমাদের অভাব অভিযোগ ছিলনা বললেই চলে।


মৃত্যুর ফাঁদ, কাপ্তাই বাধ :

কাপ্তাই বাধ নির্মাণ শুরু হয় সম্ভবত ১৯৫০ খ্রী: পর থেকে। তাহলে ধরে নিতে হবে এই বাধের পরিকল্পনা অনেক বছর আগে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা জানতেও পারিনি এমন এক মৃত্যুর ফাঁদ আমাদের জন্য তৈরী করা হচ্ছিল। আমার এখনো মাঝে মাঝে যে প্রশ্নটি বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে সেটা হচ্ছে আমাদের চাকমা রাজা কি জানতেন না,যে কর্নফুলির নদীর উপর যে বাধটি তৈরী হচ্ছে সেটি আমাদের জন্য মরণ ফাঁদ হবে? তার প্রাসাদ ডুবে যাবে চিরকালের মতো? যদি জানতেন তাহলে প্রতিবাদ করেননি কেন? অন্য কিছু কি ছিল? যাহোক- একদিন গ্রামে এসে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের কর্মচারীরা এসে জানালেন যে কর্ণফুলির নদীর উপর ‘বিদ্যুৎ’ উৎপাদনের জন্য একটি বাধ তৈরী হবে। এতে আমাদের গ্রাম সহ হাজার হাজার গ্রাম চিরতরে পানিতে তলিয়ে যাবে। আর আমাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য কোন নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে হবে। সরকার সব ব্যবস্থা করে দিবে, ক্ষতিপূরণ সহ। এরপরেই সরকারের পক্ষ থেকে ম্যাপ সহ এসে আমাদের দেখানো হয়েছিল সরকার আমাদেরকে কোথায় কোথায় পূর্নবাসনের ব্যবস্থা নিয়েছে। এমনকি সেসব ম্যাপে দাগ ক্ষতিয়ান নম্বর সহ মার্ক করা ছিল। যে যেখানে যেতে চাই সেখানে যেতে পারবে। আর যার যত জমি সম্পত্তি আছে সেসব হিসাব করে সবাইকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। তখন আমাদের জনপ্রতিনিধিরা যেমন হেডম্যান বা জমিদার বা রাজা কেউ এসে আমাদের সাথে লোকজনের সাথে এই বিষয়ে কখনো আলোচনা করেননি। সরকারের প্রতিনিধিরা আমাদের সবাইকে একটি করে ফরম দেন, পরে সেগুলো পূরণ করে তাদেরকে ফেরত দিতে হয়েছিল। আমাদের কাছে সংগৃহে রাখার মত কোন ফরম বা ডকুমেন্টস তারা আমাদের দেয়নি আজ এতো বছর পরে মনে হয় সেসব তারা পরিকল্পনা মাফিকই করেছিল।

কোন ঘটনা ঘটলে এখন যেভাবে প্রতিবাদ হয় সেরকম ভাবে সেসময় আমরা কোন প্রতিবাদ করতে পারিনি। আমাদের নেতারাও করেননি। মনে আছে দেশ ভাগের সময় আমরা যাদেরকে আমাদের নেতা ভাবতাম যেমন ঘনশ্যাম বাবু, তারা সকল্ইে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। আমরা যখন জানতে পারলাম এই বাধের ফলে আমাদের সবকিছু ডুবে যাবে কিন্তু জানার পরও আমাদের কিছু করার ছিলনা। তাই আমরা আমাদের নিয়তিকে মেনে নিয়েছিলাম। তবে অনেকে ফর্ম পূরণ করেনি এই বিশ্বাস থেকে যে, একটি নদীর পানি বাধ দিয়ে যেমন রাখা যায়না আর গেলেও এই নদীর পানি দিয়ে আমাদের গ্রাম ডুবে যেতে পারেনা। তবে আমার বাবা বিশ্বাস করেছিলেন তাই ফর্ম পূরণ করেছিলেন একেবারে প্রথমে। ফরমে ১ম চয়েস হিসাবে কাচালং ফরেষ্ট আর ২য় চয়েস খাগড়াছড়ি এলাকার নাম ছিল। ফরম হাতে পাওয়ার পর বাবা আমাকে জীজ্ঞেস করেছিলেন আমরা কোথায় যাবো ! আমি বাবার কাছ থেকে একদিন সময় নিয়ে চলে গিয়েছিলাম গ্রামের অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের কাছে জানতে যে কে কোথায় যাবে বলে ঠিক করেছে। কেউ কেউ ‘চেঙেই কূল’ যাবে বলে ঠিক করেছে। আর কেউ ‘কাজালং ফরেষ্টে’। আমি সবার সাথে আলোচনা করলাম করে ঠিক করেছিলাম আমরা কাজালং ফরেষ্ট এলাকায় যাবো। সিদ্বান্ত নেওয়ার কারণ হচ্ছে এই এলাকা সম্পূর্ণ রির্জাভ ফরেষ্ট এলাকা। নিজেরা নিজেদের প্রয়োজন মতো জংগল কেটে জমি গড়ে নিতে পারবো। আর খাগড়াছড়ি যেহেতু জনবসতি এলাকা সেখানে গেলে হয়ত: আমরা ঠিকমত প্রয়োজনমত জায়গা নাও পেতে পারি এবং হয়তোবা সেখানকার কারোর জমিতে দখল করে বসতি গড়তে হবে। সেটা ভালো হবেনা।

কাপ্তাই বাধ আমাদের ঝগড়াবিল এলাকা থেকে মাত্র ২০/২২ মাইল দূরে ছিল। ১৯৫৯ সালের দিকে আমরা আমাদের গ্রাম জায়গা জমি ভিটেমাটি ছেড়ে আমাদের জন্য নির্ধারিত ফরেষ্ট এলাকা মারিশ্যায় রুপকারীতে চলে আসি। এই এলাকার রির্জাভ ফরেষ্টের গহীণ জংগলে আমরা বসতি স্থাপন করি। আমরা ৩৭৬ নং ৩ টিলা মৌজা সৃষ্টি করি। গহীণ বলতে গহীণ যেখানে সূর্যের আলো সারাদিনই মাটিতে পড়েনা। এমনই গহীণ এলাকায় আমাদের নতুন জীবন শুরু করেছিলাম আমরা।

ঝলমল আলোর জন্য জীবন :

কাপ্তাই বাধ হবে আর সেই বাধ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, আর বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে আমাদের চাকমাদের ঘরে ঘরে আলো জলবে, সেই আলোর জন্য আমাদের কোন টাকা খরচ করতে হবেনা। সেই সংগে ক্ষতিপূরণও দেয়া হবে এই ছিল পাকিস্তান সরকারে বার্তা আমাদের মত ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের প্রতি। কাপ্তাই বাধের ফলে ডুবে যাওয়া জায়গা জমির জন্য আমরা ক্ষতিপূরণ পেয়েছি। হ্যাঁ, সেগুলো ছিল সরকার নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ। কিন্তু এই ক্ষতি পূরণ দিয়ে কি ডুবে যাওয়া জমি ঘরবাড়ি, চিরতরে হারিয়ে ফেলা হাজারো স্মৃতিময় জায়গা ফিরে পাবো ? এই ক্ষতিপূরণ না দিলে আমরা কি কিছু করতে পারতাম?? পারতাম না। তবে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছিল খুব অদ্ভুত নিয়মে। মোট জমিকে তিন ভাগে ভাগ করে অর্থ্যাৎ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করে একর প্রতি জমির ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হয়েছিল। যেমন- ১ম শ্রেণীর জমির ক্ষতিপূরণের দাম হচ্চে ৯০০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর জমির দাম ৬০০ টাকা আর তৃতীয় শ্রেণীর দাম ৩০০ টাকা করে নির্ধারিত ছিল। ঘর ভিটা প্রথম শ্রেণী ভুক্ত হওয়ায় তার দাম ছিল ৯০০ টাকা। কিন্তু হলে কি হবে ৪ থেকে ৫ টা গ্রামের মানুষ বাদে বাকিরা যারা সবকিছু হারানোর দলের মানুষ তারা কেউ আর এই ৯০০ টাকার ক্ষতিপূরণ পাইনি। আমার যতটুকু মনে আছে চাকমা রাজাও ৯০০ টাকার ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। আপাত: দৃষ্টিতে ক্ষতিপূরণের পরিমান অনেক মনে হলেও ‘উদ্ভাস্ত’ হওয়ার তুলনায় কিছুই না।

অন্যদিকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে পূর্ণবাসনের জন্য যে জমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছিল সে হিসাবটা বড়ই মর্মান্তিক আর গোলমেলে। জনপ্রতি হিসাব করে পরিবারের জন্য জমির বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। প্রতি ১ জনে ১ একর। তবে প্রত্যেক পরিবার মাত্র সর্ব্বোচ্চ ১০(দশ) একর করে জমি পাবে। তাও সেসব পরিবার ১০(দশ) একর জমি পাবে যদি তাদের পরিবারে ১০(দশ) জন সদস্য থাকেন এবং পুরোনো জায়গায় ১০ একরের বেশী জমি ছিল। আর সে ১০(দশ) জন সদস্যের মধ্যে মায়ের কোলে শিশুও গোনার মধ্যে পড়েছিল। আর যেসব পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১০(দশ)জন নয় কিন্তু পুরোনো জায়গায় তাদের ২০ একরও বেশী জমি ছিল সে পরিবার নতূন জায়গায় ১০(দশ) একর জমি বরাদ্ধ পাবেনা। শুধু তাই নয়, যে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১০ জনেরও বেশী তাদের জন্য জমি নির্ধারিত হয় ঐ ১০ একরেই। এক্ষেত্রে পুরোনো জায়গায় সমপরিমান জমি ছিল এই প্রমাণ দেখাতে হয়েছিল।এই ‘অদ্ভুত এবং মর্মান্তিক’ নিয়মের ফলে আমার চেনা পরিচিত অনেক অনেক পরিবার সহায় সম্পত্তিহীন ব্যাক্তিতে পরিণত হয়ে গেল। কারণ জনপ্রতি এক একর জমি বরাদ্ধ ছিল মাত্র তাদের। অসহায় থেকে আরো অসহায় হয়ে পড়ে তারা। কিন্তু আমাদের করার কিছুই ছিলনা। পুরাতনকে পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস আর কান্নাকে সাথী করে আমরা নতুন জায়গায় চলে এলাম। সংগে অবশ্য এই আশা নিয়ে এলাম যে একদিন আলো ঝলমল হয়ে উঠবে আমাদের এলাকা হয়তো সেটা হবে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে। কারণ সেইভাবেই সরকারের পক্ষ থেকে বুঝানো আমাদের হয়েছিল।

পানির তলে গ্রাম:

: বাধ শুরু হবার পরপরই আমাদেরকে জানানো হয়েছিল যে কিছুদিনের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে নতুন জায়গায় যেতে হবে। আলোচনা, ফরম পূরণ করা, নতুন জায়গা দেখে আসা অন্যান্য সব কিছু মিলিয়ে সময় কখন ফুরিয়ে যাচ্ছিল সেটা প্রথমেই বুঝতে পারিনি। গ্রাম ছাড়ার সময় যখন এল তখন শুরু হল আসল মানসিক যন্ত্রণা। গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেল, হাহাকার, বিশ্বাস অবিশ্বাস, দীর্ঘশ্বাস। এসব অনুভূতি আসলে বলে বুঝানো যায়না। শুধু মানুষের কান্না না। গৃহপালিত পশু পাখির করুণ ডাকও মিশে গেল মানুষের কান্নার আর হাহাকারের সাথে। বিড়ালর মিউ মিউ করে কান্না করতে থাকল আর কুকুরদের করুণ স্বরে ডাকের কথা কি আর বলব। ওদের ডাকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল অমংগলের চিহ্ন। দিনের পর দিন রাত গভীরে করুণ স্বরে ডাকতে ডাকতে ঝাঁক ঝাঁক পাখি উড়ে যেত একদিক থেকে আরেকদিকে। চারিদিকে মৃত্যুর চিহ্ন। জীবনের চীহ্ন যেন হারিয়ে গেছে চিরতরে।

এসবের মধ্যে আমরা ১৯৫৯ খ্রী: চলে আসি পুরাতন গ্রাম ছেড়ে নতুন জায়গায়। আমরা যেসময় গ্রাম ছেড়ে এলাম তখনো আমাদের গ্রামে পানি আসেনি। আমি আমার গ্রামের দলপতি ছিলাম। প্রত্যেক গ্রামের একজনকে দলপতি নির্বাচিত করে দিয়েছিল সরকার। আমার পরিবারকে রাংগামাটি শহর রেখে কাজালং ফরেষ্ট এলাকায় চলে গিয়েছিলাম দলবল সহ জমি জমার দখল বুঝে নিতে। তবে গ্রামের অনেকেই গ্রাম ছেড়েছে পানি আসার পর। আমাদের বেশীর ভাগ আত্মীয় স্বজন চলে গিয়েছিল খাগড়াছড়ি জুমমরং এলাকায়। কিছু আত্মীয় স্বজন চলে যায় মাইনি বাবুছড়ায়। আমাদের গ্রামের মারমারা কিছু গেছে মাটিরা্গংায় আর কিছু বান্দরবানে। আর বাঙ্গালী প্রতিবেশীরা ফিরে যায় তাদের পুরাতন গ্রামে ক্ষতিপূরণ নিয়ে। আর আমরা মাত্র চার খুরততো ভাই চলে যায় কাজালং এ। যাইহোক ,কাজালংএ গিয়ে জায়গা জমি দখল নেওয়ার পরপরই আমি আবার ফিরে এসেছিলাম আমাদের গ্রামে। ফিরে এসে দেখি গ্রামে পানি চলে এসেছে। ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে ঝগড়াবিল গ্রাম। আমারই চোখের সামনে বাগান বাগিচা, বাড়ি ঘর সব সব পানির নীচে চলে গেল। যারা তখনও গ্রামে ছিল তারা ব্যস্ত পানির হাত থেকে নিজেদের কিছু জিনিষ রক্ষা করতে। গতবার গ্রাম ছেড়ে যাবার সময় আমি আমার এক প্রতিবেশী বাঙালীকে আমাদের ৩০০ গরু ছাগল এর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলাম আমি না ফেরা পর্যন্ত দেখাশুনা করার জন্য। কিন্তু ফেরার পরে তাকে আর গ্রামে পাইনি এমনকি কোন গরুছাগলও খুঁেজ পাইনি। আমি আসার আগেই সব গরু ছাগল নিয়ে সে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমি যখন ফিরেছি তখন আমাদের বাড়ী পানিতে ডুবে গেছে,তাই স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে আমি আমাদের পুরাতন খাট পালং বা অন্য কোন ফার্নিচার রক্ষা করতে পারিনি । হাজারো দু:খের মধ্যে এটি আমার অন্যতম দু:খ।

এবার যাবার পালা : তখনো পর্যন্ত যারা গ্রাম ছেড়ে যায়নি তারা নিজেদের জন্য নৌকা ভাড়া করে সবকিছু বাচাঁনোর চেষ্টা করছে। লোকজন পারলে ঘর শুদ্ধ নৌকায় তুলে নতুন জায়গায় নিয়ে যায়। কিন্তু সেটাতো সম্ভব নয় তাই নৌকায় যা ধরে সেটুকু নিয়েই গ্রামের লোকজন গ্রাম ছেড়েছিল একেবারের জন্য। পথে যাতে কোন বিপদ না ঘটে সেজন্য সাথে করে সরকার পুলিশ সদস্য দিয়েছিল। সরকার আমাদের মত এইসব শরনার্থী লোকজনের যাতায়তের সুবিধার জন্য রাস্তার মধ্যে নদীর পাড়ে পাড়ে ছোট ছোট ঘর বা তাবু বেধে রেখে দিয়েছিল সাথে পুলিশ সদস্য যাতে কোন সমস্যা না হয়। কারণ একেকটা জায়গায় পৌঁছাতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন দিন লাগত। আর পথ খরচ বাবদ ১১ টাকা করে দিয়েছে সরকার সবাইকে। অনেক নৌকা একসাথে সারি বেধে যাচ্ছে, এগুচ্ছে সেটা দেখার মত ছিল। কাদঁতে কাদঁতে সবাই গ্রাম ছেড়ে এসেছি। যথাসময়ে আমরা কাজালং এ এসে পৌঁছলাম। আমাদের জন্য কাজালং পারে ছোট ছোট করে বাসা বাধা হয়েছে। চারিদিকে মানুষ আর মানুষ। সন্ধ্যা নামলে কাজালং পার দেখার মত হয়। যখন কুপির বাতি জলে টিম টিম করে তখন মনে হয় মেলা বসেছে। ইতিমধ্যে লোকজন ক্ষতিপূরণে টাকা হাতে পেয়ে কেউ কেউ রেডিও কিনেছে। সেই রেডিও থেকে গান বাজছে। সেএক ধুমধাম অবস্থা। এসময়ে এদের দেখলে কারোর মনেও হবেনা যে এরা সর্বস্বান্ত হয়ে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছে। অনেক সময় দু:খ বেদনা গুলো মানুষ কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভূলে থাকতে চাই নানা ভাবে। হতে পারে এই রংঢং বেদনা ভূলার অন্যরকম চেষ্টা।

সরকার ঝগড়াবিল থেকে কাজালং আসার পর ‘ঝগড়াবিলের গ্রুপের লীডার হিসাবে’ নতুন মৌজার হেডম্যান পদে আমাকে নমিনেশন দিয়েছিল। কিন্তু আমি হেডম্যানশীপ পাইনি। এই হেডম্যানশীপ নিয়ে চাকমা রাজা অনেক কুটনীতির চাল চালিয়েছিলেন। কাজালং এলাকার আমাদের মৌজার হেডম্যানশীপটা তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় নিজের কাছে রেখে দেন। শুধু তাই নয় একই সংগে আরো ২টা জায়গার হেডম্যানশীপ রাজা তার হাতে রেখে দেন। সবাই যখন এই নিয়ে প্রশ্ন তুলে তখন রাজা বলেছিলেন কিছুদিন পরেই এই হেডম্যানশীপগুলো যথাযথ মানুষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ক্ষমতা নিজের হাতে রাখার চক্রান্তের অংশ হচ্ছে এই ২/৩টা হেডম্যানের পদ নিজের কাছে রেখে দেয়া। যাহোক বেশ কিছুদিন পরে আমাদের মৌজার হেডম্যান পদটা দেয়া হয় উষাময় দেবানের হাতে। পরে হাট্টলী মৌজার হেডম্যান পদটাও আরেকজনের কাছে হস্তান্তর করা হয় । আর এই সকল হেডম্যান সকলেই ছিলেন রাজা ত্রিদিব রায়ের ঘনিষ্ট আত্মীয়। সাধারণ জনগনের কাছে যাতে ক্ষমতাগুলো চলে না যায় সেজন্য রাজা এই কুটনীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে আমি মনে করি। জনগণের জন্য কাজের কাজতো এই রাজারা করেননি কখনো।

বেঁেচ থাকার কঠিন লড়াই :

পুরাতন জায়গা ঝগড়াবিল আদামকে পানির নীচে রেখে আমরা নতুন জায়গায় এসে থিতু হওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করলাম। সে এক কঠিন কষ্টের নতুন জীবন। আমরা কেউ এই জীবনে অভ্যস্ত ছিলামনা, এমনকি এই জীবনের কথা কল্পনাতেও ছিলনা। নতুন জায়গায় বিশাল বিশাল গাছ কেটে জংগল সাফ করে বাড়ী বানানোর জন্য জায়গা, চাষ করার জায়গা সৃষ্টি করতে হয়েছিল আমাদের। কত ভয়ংকর হিং¯্র প্রাণী চারিদিকে ঘোরাফেরা করে। সূর্যের আলো জংগলের উপরেই থাকে। মাটি পর্যন্ত পৌঁছায় না এমন জায়গায় আমাদের থাকতে হয়েছিল। প্রথম প্রথম সবকিছু ভয় লাগত, বেশীর ভাগ মানুষ বিশেষ করে শিশু আর বয়স্ক মানুষেরা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কলেরা, ম্যালেরিয়া আর পেটের অসুখ আরো কত রোগশোকে ভুগে কত জন যে মারা গেছে তখন সে হিসাব আমরা কেউ রাখিনি।

হাতে টাকা আছে কিন্তু বাজার ঘাট কই! ধীরে ধীরে অভাব অনটন ঘিরে ধরতে শুরু করেছিল। আর রাংগামাটি শহরের কাছাকাছির মানুষ হবার কারণে আমরা শহরে হাওয়ায় একটু অভ্যস্ত ছিলাম। সেই অভ্যস্ততাও কাটা হয়ে বিধছে। এখন সেসবতো স্বপ্নের মত। সব মিলিয়ে সকলের জীবম্মৃত অবস্থা হয়ে গেল। সবাই আমরা ভেবেছিলাম আর বোধহয় আমরা বাঁচতে পারবোনা। এভাবে কিছু সময় চলে যায়। মানুষ অভ্যাসের দাস। ধীরে ধীরে আমরাও এখানে এই নতুন জায়গায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। পুরাতন বাড়ী ঘর ডুবে যাবার পর বাবা ২ বছর রাংগামাটিতে ছিলেন। পরে বাবা এখানে চলে আসেন। আর চলে আসার ১ বছর পর বাবা এখানে মারা যান। সালটাও মনে আছে আমার ১৯৬১ খ্রী: বাবা এই রুপকারীতে মারা যান। বাবার বয়স তখন ৮৯ বছর। মা তো অনেক আগে মারা গেছেন।

আমার সাথে যে জেঠাত ভাই এখানে এসেছিলেন, গোপালকৃঞ্চ চাকমা যার নাম তিনি একদিন এসে আমাকে বললেন ‘চিক্ক আমি আর এখানে থাকতে পারছিনা। এই জায়গা থেকে আরেকটু ভিতরের দিকে যেতে চাই। এখানে থাকলে আমাকে না খেয়ে থাকতে হবে। আমার ভাতের যোগান এখান থেকে হবেনা। তাই আমি চলে যাবো।’

‘কেন দাদা? আমরা মাত্র ক’ভাই এখানে এসেছি। এখানে দুই ভাই আছি পাশাপাশি। এখন আমরা আলাদা হয়ে গেলে আপন বলতে তো আর কেউ থাকবেনা দাদা!’

‘আমার অনেক ছেলেমেয়ে। এখানে আমাদের জায়গার সংকুলান হচ্ছেনা। এখন হয়তো থাকতে পারব কিন্তুছেলেমেয়ে গুলো বড় হয়ে গেলে তখন মুশকিলে পড়ে যাবো। তাই সময় থাকতে আমার যাওয়া উচিত।’ তাই দাদা অন্য জায়গায় চলে গেলেন। আমাদের এই জায়গা থেকে বেশ দূরের একটা জায়গায়। আর আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম। আপন বলতে সেইতো ছিল।

তখনও কিন্তু ভঙ্গলতুলি এলাকা আমাদের জন্য বরাদ্দ হয়নি। বরাদ্দ ছিল শুধুমাত্র রুপকারী এলাকা। । কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আমরা যে নতুন জায়গাকে কেটেকুটে সাফ করে বসবাসের যোগ্য করেছি সেসব জমি কয়েকবছরের মধ্যে ডুবে যায় কাজালং নদীর পানিতে। সেই একই কারণ কাপ্তাই বাধ এর পানি বেড়ে আমাদের এই জমিগুলো ডুবে যায়। শুধু শীতকালেই এই জমি গুলো জেগে থাকে। আর বাকি সময়টা কাপ্তাই বাধের পানির নীচে ডুবে থাকে। নতুন জায়গায় এসে আমি এবার নিজের নামে একটা বন্দুক নিলাম। কিন্তু ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তি বাহিনীরা আমার সেই বন্দুকটি নিয়ে যায়। কিন্তু তারা আর আমার সেই বন্দুকটি ফেরত দেয়নি।

চাকমা ভাষায় একটা প্রবাদ বাক্য আছে : ‘কবা পিত্ত র’ নেই ডুলি পিলে র’ নেই” এমন জায়গায় আমরা নতুন গ্রাম বেধেছি। কাজালং নদীর পাড় থেকে আমাদের গ্রামে আসতে এখন আধা ঘন্টারও বেশী সময় লাগেনা। যখন নতুন নতুন আমরা এখানে এসেছি তখন একদিন লাগতো। ঘন জংগল। সূর্যের রোদ মাটিতে পড়েনা এমন জংগল দিয়ে গ্রামে আসতে হতো। এমনই একসময় আসার পথে আমাদের গ্রামের ২ জন লোককে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। তাদের আর পাওয়া যায়নি। হাতি বাঘ এতো ছিল। এখানে আসার পর লোকেরা ‘খেদার’ করেছিল। ১৪/১৫ টি হাতি ধরা পড়েছিল। এটা ৫৮/৫৯ সালের কথা সম্ভবত:। এইসব লোকেরা আমাদের আগে বসতি গড়েছিল এখানে। ও একটা কথা বলতে ভূলে গেছি আমাদের জায়গা বুঝিয়ে দিতে আমিন কানুনগো এসেছিল আমাদের সাথে। কিছুদিনের মধ্যে আমাদের সাথে যারা এসেছিল তাদের অনেকেই বড়পড়ং এ চলে গিয়েছিল। তাদের ফেলে যাওয়া জায়গা জমি আমাদের মধ্যে ভাগ হয়েছিল। ৬১ খ্রী: থেকে ৬৪ খ্রী: এর মধ্যে বেশীর ভাগ মানুষ বড়পড়ং এ চলে যায়। চলে যাওয়ার তখন অন্যতম কারণ ছিল, প্রয়োজন অনুযায়ী জায়গা জমি ভাগ না পাওয়া। তাই ভবিষ্যৎের কথা ভেবে ওরা চলে যায়। কারণ ক্ষতিপূরণ নিয়ম অনুযায়ী সদস্য সংখ্যা ১০ জনের কম হলেই ১০ একর জমি পাওয়া যেতোনা। অথচ অনেকের পুরাতন জায়গায় ডুনকে ডুন জমি ছিল। ছোটখাট জমিদারী ছিল অনেকের। তারা এখন ভিখারী। তাই অগ্যতা দেশ ছেড়ে দূরদেশে যাওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর ছিলনা তাদের। আমার ভাইয়ের ছেলে একজন মিজোরামএ বসতি স্থাপন করে। তার ছেলে মিজোরামের এমএলএ হয়েছিল এ।।
©CHT- Indigenous Movement "পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী আন্দোলন" 

Comments

Popular posts from this blog

আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র

প্রসঙ্গ জাতীয়তাবাদঃ তুষার শুভ্র তুলু

আদিবাসী অধিকার কি,এগুলো কোথায় পাবো ?