চাঙমাদের আহ্'ল পালনির ইতিবৃত্ত
চাঙমাদের জাতীয় সংস্কৃতিতেও যেসব উৎসব পার্বন পালন করা হয় তন্মধ্যে ‘আহ্ল পালনী’ অন্যতম। এই আহ্ল পালনী উৎসব কবে কিভাবে প্রবর্তন হয় তা চাকমাদের কেউ নির্দিষ্টভাবে জানে বলে মনে হয় না। এই না জানার কারণে হয়ত ব্যতিক্রমভাবে উদযাপন করে থাকে। চাকমারা এ উৎসবটি পালন করে আষাঢ় মাসের সাত(৭) তারিখ। এই দিনটিতে তারা কর্ম বিরতি দেয়। জুম্মোরা জুমে এবং ভূইয়েরা ভূইয়ে কাজ করে না। এক কথায় কেউ দা, কোদাল মাটিতে স্পর্শ করায় না। সেদিন অনেকেই মুরগী কেটে ভাত খায়। মা লক্ষীকে ভাত দেয়, মদ পান করে এবং অতিথি নিমন্ত্রণ দিয়ে আপ্যায়ন করে। তবে ইদানিং এর উদযাপন তেমন হয়না বললেই চলে। বিঝুর মত এ দিনটিতে পাঝন বানানো হয়না তবে বিভিন্ন পিঠা তৈরী করা হয়। বিঝুর ন্যায় তেমন জাকজমকপূর্ণ হয়না এ উৎসব। উপরন্তু নিষ্কর্মা হয়ে ঘরে বসে থাকে মানুষজন। বস্তুত এটিও শাক্য জাতির প্রবর্তিত হলকর্ষণ উৎসবের প্রতিভূ যা কালের পরিক্রমায় পরিবর্তন ঘটেছে। হাজার বছরের সংস্কৃতির মূল স্রোত এক প্রকার বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গেছে। উৎসবটা ঠিকই রয়ে গেছে কিন্তু এর উদযাপনের ধরনটা পরিবর্তন হয়েছে। চাকমা জাতি দীর্ঘ রাজনৈতিক ও ভৌগলিক পট পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতির আগ্রাসনে পড়েছে যার কারণে মূল সংস্কৃতির অনেক কিছু হারিয়ে গেছে অথবা বিবর্তিত হয়েছে। এই ‘হল কর্ষণ’ বা ‘আহ্ল পালনী’ উৎসবটাও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হলকর্ষণ বা আহ্ল পালনী উৎসবের বিবর্তনের কারণ খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কৃত হল হিন্দুদের অম্বুবাচি নামক একটি উৎসব। এই অম্বুবাচি ভারতের আসাম রাজ্যের কামরূপ কামাখ্যা মন্দিরকে ঘিরে সৃষ্টি হয়। এটি মূলত ধরীত্রির ঋতুচক্র উৎসব। হিন্দুরা মনে করে ধরিত্রী এ সময়ে ঋতুমতি হয়ে অশুচী থাকে। এ ঋতুচক্রের মাধ্যমে মাটি তার উর্বরতা বৃদ্ধি করে। এ সময় হাল ধরা, গৃহ প্রবেশ, বিবাহ ইত্যাদি শুভ কাজ করা নিষিদ্ধ। এ সমস্ত বিরতির মাধ্যমে তারা ধরিত্রীকে উপাসনা করে। তারা বিশ্বাস করে এ উপাসনা করলে প্রচুর পরিমাণে শস্য ও সব্জির ফলন হয়। অম্বুবাচির সময়কাল চার দিন স্থিতি থাকে। এটি ইংরেজি জুন মাসের ২১ কিংবা ২২ তারিখ হতে পরবর্তী তিনদিন পর্যন্ত পালন করা হয়। হিন্দুদের বিশ্বাস মতে আষাঢ় মাসে মৃগ শিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে পৃথিবী বা ধরিত্রী মা ঋতুময়ী হয়। তাই এই সময়টিতে অম্বুবাচি পালন করা কর্তব্য।
ছবি : Bangkok post
অম্বুবাচি বা ঋতুচক্র উৎসব সম্পর্কে জহর সরকার লিখেছেন-
“পূর্ব ভারতের দিকে তাকানো যাক, বিশেষত গুয়াহাটির নিকটবর্তী কামাখ্যা মন্দিরে। এটি আদিতে তান্ত্রিক আচারের কেন্দ্র। জুন মাসের শেষে ধরিত্রীর ঋতুকাল উদ্যাপন— অম্বুবাচি— এক সর্বজনীন উৎসব, নানা মেলা ও অনুষ্ঠান জমে ওঠে তাকে ঘিরে। এই শক্তিপীঠটিতে নাকি সতীর যোনি পড়েছিল। প্রাচীন কালে এই অঞ্চলের কাছাকাছি প্রাগ্জ্যোতিষপুরে এক বিরাট সভ্যতা ও শক্তিশালী রাজত্বের উদ্ভব হয়, পরে, চতুর্থ থেকে নবম শতাব্দীতে প্রেম এবং কামের দেবতার নামে যা কামরূপ নামে প্রসিদ্ধি অর্জন করে। মাতৃদেবীর আরাধনা এবং শিবের কাহিনির সঙ্গে এই ঐতিহ্যের সংযোগ ছিল সুপ্রাচীন, কিন্তু বৈষ্ণবধর্মও একে অগ্রাহ্য করেনি, বরং নরকাসুর, ভূমি দেবী এবং আরও পরের নারায়ণ-উপনিষদের গল্প তৈরি করেছিল। মাতৃশক্তির এই আরাধনার ঐতিহ্য এতই শক্তিশালী যে, দেবীর ঋতুচক্রের প্রতীক স্বরূপ ছোট ছোট লাল কাপড়ের টুকরোকেও লক্ষ লক্ষ ভক্ত মাথায় তুলে রাখেন। এখানে খেয়াল করা ভাল, লাঙ্গল কথাটা এসেছে লিঙ্গ থেকে— লাঙ্গল ভূমির গভীরে প্রবেশ করে ফসল ফলায়। জীবন এবং প্রজনন সম্পর্কে লজ্জার কোনও কারণ আমাদের প্রাচীন ঋষিরা দেখেননি। লক্ষণীয়, অম্বুবাচির এই সময়টাতে মাঠে লাঙ্গল দেওয়া নিষিদ্ধ।”
উপরোক্ত উক্তির মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম চাকমারা যে অর্থে ‘আহ্ল পালনী’ পালন করে তা হিন্দু সংস্কৃতির অনুযায়ী যা আদি শাক্য জাতি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘হল কর্ষণ’ উৎসবের সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত। অবশ্যই অনেক চাকমা গবেষক তাঁদের গবেষণায় হিন্দুদের অম্বুবাচি উৎসবের পক্ষে সাফাই গেয়ে এর স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু আমি জোড়ালোভাবে এর বিরোধিতা করি। আমাদের আহ্লপালনী কখনও হিন্দুদের অম্বুবাচী নয় এবং হতে পারে না। তাই এখানে আমি বলতে চাই এই আহ্ল পালনী উৎসবটা আমাদের আদি সংস্কৃতির একটি অংশ যা আমাদের পূর্বসূরী শাক্য জাতির বাৎসরিক জাতীয় উৎসব। এ জন্য চাকমা জাতির উচিত হবে মূল ধারায় ফিরে গিয়ে মূল উৎসবকে সঠিকভাবে পালন করা। আহ্ল পালনী অর্থ কর্ম বিরতি নয় বরং আহ্ল ফেলানি বা হল কর্ষণ। এই হল কর্ষণের মাধ্যমে জমিতে হাল চাষের উদ্বোধন করা। সারা পৃথিবীতে যেখানে চাকমা রয়েছে এবং কৃষি জমিতে চাষাবাদ করে তাদের দরকার একযোগে একই দিনে কৃষি চাষ আরম্ভ করা। বিঝু উৎসবের মত এটিও জাকজমকপূর্ণভাবে উদযাপন করা। এটি আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, আর জাতীয় ঐক্যের প্রতীকও বটে। এ উৎসব বৌদ্ধ ঐতিহ্য বিধায় থাইল্যাণ্ড, কম্বোডিয়া ও মায়ানমার সহ বিভিন্ন বৌদ্ধ প্রধান দেশে সাড়ম্বড়ে পালন করে থাকে। তাই আমাদেরও উচিত হবে নিজ ঐতিহ্যকে ধারণ করা, লালন করা। শাক্য জাতি ও চাকমা জাতি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে, সংস্কৃতিগতভাবে এক ও অভিন্ন। এর পক্ষে বহু তথ্য প্রমাণ আমরা পেয়েছি। সুতরাং আসুন আমরা আমাদের সুপ্রাচীন মূলধারার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে চর্চা করি, জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের অবস্থান সুসংহত করি এবং যাবতীয় নেতিবাচক চরিত্রের সংশোধনের মাধ্যমে উন্নত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হই।
লিখেছেন- মেয়েরেগা
Comments
Post a Comment