চাক আদিবাসী জীবনধারা
বাংলাদেশের আদিবাসী-জাতি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চাক সম্প্রদায় সংখ্যালঘু জাতির মধ্যে অন্যতম জাতি।
-আদিবাসী সংস্কৃতি ও জীবনধারা
চাক সমাজে নিজেদেরকে আচাক বলে থাকে।
বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলার তথা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলার মধ্যে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় তাদের বসবাস। বর্তমানে জীবন জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন জেলায় চাক সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করে।
পটভূমি :
চাক সমাজ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। আগের প্রথানুযায়ী গর্ভবতী মহিলাকে নিজের স্বামীর ঘরে সন্তান প্রসব করতে হত। এখন কিছুটা এ নিয়ম পরিবর্তন হতে দেখা যায়। পূর্বে বয়স্ক মহিলারাই গর্ভবতী মহিলাদের প্রসব করাতেন। চাক সম্প্রদায়ের মধ্যে নবজাতক শিশুর নাভি( আছুলু ) ছিড়ে না যাওয়া পর্যন্ত (তাকহুং ) চুলার বাম পাশে বিছানা করে থাকতে হয়। যখন নাভি (আছুলু ) ছিড়ে যায় তখন (কিংতং ) ঘরের ভিতর প্রবেশ করে এবং সপ্তাহ খানেকের পর (ফাইকলিঙ্ক ) দোলনা বানানো ও নাম দেওয়ার অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সীমিত আকারে হলেও পাড়ার গণমান্য ব্যক্তিদের ডেকে খানার আয়োজন করা হয়। দোলনা বানানোর মূল দায়িত্ব থাকে আউ (মায়ের বাবা) নানা কিংবা মামা এবং নাম দেওয়ার বিষয় যে বয়স্ক মাহিলারা প্রসব করিয়েছেন তারা দিন সবকিছু মিলে নাম দেবে। সেই অনুষ্ঠানে বয়স্ক মহিলাদের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হলে সেইসব বয়স্ক মহিলাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পোশাক-আশাক প্রদান করা হয়।
সমাজ ব্যবস্থা:
চাক আদিবাসী মানুষ বোমাংকে রাজা বলে। রাজা তাদের প্রথা অনুযায়ী রীতি -নীতি, ভূমি, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, পার্বত্য জেলা পরিষদে যোগ দেওয়া, কার্বারী নিয়োগ ও হেডম্যান নিয়োগের কাজ করে থাকে। গ্রামের রোয়াজা কার্বারীর মাধ্যমে ঝগড়া ও নানা সমস্যার নিষ্পত্তি করে থাকেন। হেডম্যানরা অনেক কাজ করলেও মূল কাজ খাজনাদি আদায় করা।
পোশাক ও অলংকার:
চাক নারীরা এক প্রকার নিফিং (থামিং ) তৈরি করে থাকে। চাক সম্প্রদায় নিজেদের নিফিংকে (থামিং ) আচাক নিফিং বলে থাকে। নারীদের পোশাক অনেকটা মার্মা নরীদের মত পরিলক্ষিত হই। চাক পুরুষরা কামু( লুঙ্গি) ও বিভিন্ন রংঙের পোশাক পরিধান করে। চাক নরীরা সোনা রুপার তৈরি হাতের বালা, কানের ফুল, গলার হারের অলংকার পরে। যারা বয়স্ক মহিলা তারা মাথায় আপঙ (কালো কাপড় দিয়ে তৈরি) এবং বুকে
রাঙ্কেং ( কাপড় দিয়ে তৈরি) এবং কোমরে বিভিন্ন মুদ্রা দিয়ে একটি সুতায় গেথে ব্যবহার করে। চাক বয়স্কের মহিলারা নটং (কানের ফুল) বড় বড় ব্যবহার করে।
খাবার:
চাকরা জুম চাষ ও জুম ফলনের মাধ্যমে নিজেদের খাবার উৎপাদন করে। চাকরা তৈজসপত্র হিসেবে কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি ব্যবহার করে। চাকদের প্রিয় খাবারে তালিকায়
কাইংদাক (শাক) ও
কাইংরাবুং ( যা তেল ছাড়া তৈরিবহয়)। খাবারের সময় সব খাবারের আগে মরিচ দিয়ে যে শাক খাই তাকে কাইংদাক
বলে। কলাপাতা কিংবা বাঁচের চুঙ দিয়ে তৈরি করা খাবারকে কাইংরাবুন বলে।চাকরা প্রচুর মরিচ, শুটকি, চিংড়ি ও নাপি ( যা শুটকি দিয়ে তৈরি) খেতে পছন্দ করে। তারা তেলছাড়া খাবার বেশি পছন্দ করে। চাকরা শাক দিয়ে খাওয়ার জন্য প্রচুর মরিচ, নাপি ও লবণ মিশ্রিত খাবারকে বলে
মুরুকথু বলে। আবার চাকরা কাচা শাক খেতে পছন্দ করে।
ধর্ম ও বিশ্বাস :
চাক গোষ্ঠীর মানুষগুলো মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। চাক সম্প্রদায় কঠিন চীবর দান, মাঘী পূর্ণিমা, বৈশাখী পূর্ণিমা, বুদ্ধ পূর্ণিমা, ফানুস ওড়ানো, সংঘদানসহ পালন করে থাকে। চাকদের ছেলেরা যখন ১৮ বছর পূর্ণ হয় তখন প্রবজ্যা করানো হয়। তবে বর্তমানে কিছু কিছু ছেলে মেয়ে খ্রীস্টান ধর্ম পালন করতে দেখা যায়।
বিবাহ প্রথা :
চাক সমাজে বিবাহ প্রথা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত মামাতো ভাই-বোনের মধ্য বিবাহ চাকদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। চাকদের বিবাহ দুরকম হই ১। উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে
২। চুরি করে।
চাকদের বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ। পাত্র পক্ষের প্রস্তাব ও কনে পক্ষের সম্মতি চাক সমাজের সামাজিক বিবাহের প্রথম পর্ব। পাত্রপক্ষের উদ্যোগে এই পর্ব শুরু হয়। পাত্রপক্ষের পরিচিতি ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি কিংবা নিকট অথবা দূরসম্পর্কীয় কোন আত্মীয়কে পাত্রীপক্ষের নিকট বিয়ের প্রস্তাব পৌঁছে দেন। পাত্রীপক্ষের অভিভাবকের
হ্যাঁ সূচক সম্মতি পাওয়া গেলে পাত্রের পিতা-মাতা, বন্ধু-বান্ধব ও গুরুজনদের সহ বিজোড় সংখ্যক ব্যক্তি নিয়ে তার সঙ্গে মদ, মিষ্টি, চিনি,সুপারি, পান ইত্যাদি নিয়ে পাত্রীর বাড়িতে যান। পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে মদ পাত্রীর মা-বাবাকে উপহার হিসেবে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব করেন। পাত্রীর মা-বাবার সম্মতির পর মেয়ের মতামত নেওয়া হয়। মেয়ের সম্মতি পাওয়া গেলে পাত্রপক্ষের দেওয়া মদের বোতল গ্রহণ করে অনুরুপ পাত্রীপক্ষের হতে পাত্র পক্ষকে মদ দেওয়া হয়। এ সময় উভয় পক্ষের মানুষ আনন্দে মদ পানসহ বিয়ের কথাবার্তা পাকা করা হয়। এরপর গণনা করে বিয়ের শুভলগ্ন দেখা হয়। সবকিছু শুভলক্ষণ যুক্ত হলে পাত্রী পাত্রপক্ষের গুরুজনদের প্রণাম করে আশীর্বাদ গ্রহণ করেন। এসময় পাত্র পক্ষ একটি
নিফিং (থামিং ) সোনা বা রুপার একটি নচক (আংটি ) দিয়ে পাত্রীকে আশীর্বাদ করেন। বউ আনতে যাবার দিন
চিংরে , আরাক,নিফিং ও বাজু ইত্যাদি পাত্রের মাবা কিংবা আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব ও বাদ্য বাজনা সহকারে কনের বাড়িতে যান। বিবাহ অনুষ্ঠানে পাড়ার প্রধান কার্বারি, রোয়াজা ও যুবক যুবতিদের নিয়ে বা কয়েকজন নিকত আত্মীয় স্বজন নিয়ে স্বাক্ষী হিসেবে রেখে বিবাহ করা হয়। তবে বিবাহটি শুভ অশুভ দেখার জন্য কিছু নিয়ম কানুন আছে। সেই নিয়ম কানুন দেখার জন্য আলাদা ভাবে পাড়ার প্রধানকে একটা এবং যুবক যুবতিদেরকে একটা করে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই দেখার জিনিসটাকে চাক ভাষায় পোঁ(মেলা) বলে। পোঁ
পরিচালনার জন্য দুজন আঞোই আচিকা লু নিংহু ( যিনি বিপত্নীক বা বিচ্ছেদ প্রাপ্ত নন) ২ একজন ছেলের পক্ষ অন্যজন মেয়ের পক্ষ প্রয়োজন। প্রথমে দুটি গ্লাসে মদ ঢেলে একটি হচ্ছে পাত্রের আর একটি পাত্রীর তারপর তারা একটু করে পান করার পর মদের গ্লাস অদল বদল করবে। পোঁতে মুলত দুইটা মুরগি (একটা মোরগ আর একটা মুরগি) নিয়ে মুরগির মাথার বিশেষ অংশটিকে দেখা( চাক ভাষায় আচাংগিং দেখা)। সেই আচাংগিং দেখার পর পাড়ার প্রধান থেকে শুরু করে সবাই বিবাহ বন্ধনের আশির্বাদ প্রদান করা হয় এবং বিবাহ সম্পন্ন হয়। তারপর সিদ্ধ মুরগিগুলোকে প্রয়োজনীয় উপকরণ মিশিয়ে বর -কনে সবাই খাওয়া হয়। এরপর থেকে দুজনে স্বামী স্ত্রী হিসেবে সমাজে স্বীকৃতি লাভ করে।
চাষাবাদঃ
চাক সমাজ জুম চাষ ও কৃষি চাষের উপর নির্ভর করে। চাক সমাজে বহু সামজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান জাক যমকেরর সাথে পালন করে। যেমন জুমে কিংবা বিলের নতুন ধান কাটার পূর্বে পাড়ার সকল কিংবা আত্মীয় স্বজনদের ডেকে খাওয়ানো হয়। চাকরা তাকে আংদা অহে
বলে থাকে।
কৃষ্টি ও সংস্কৃতি :
চাক সমাজে কোন প্রসূতি সন্তান প্রসব করলে আত্মীয়রা ভাত, মাছ, শুটকি ইত্যাদি নানা ধরনের তরকারি নিয়ে নবজাতক শিশুকে দেখতে যায়। চাকরা সাংগ্রাইং তিন দিন পালন করে থাকে। সংগ্রাইং আগের দিন শিশু, কিশোর, তরুণরা মিলে বন থেকে ফুল সংগ্রহ করতে যায়। পরদিন ফুলগুলো বিহার, জাদিতে দান করা হয়।
সাংগ্রাইং দিনে বিভিন্ন খাবার রান্না করা হয়। পিঠা, পায়েস, বিভিন্ন রকমের
আংছা (বিনি ভাত) সামাই ইত্যাদি রান্না করা হয়। মূল সাংগ্রাইং দিনে বুদ্ধকে বিভিন্ন চন্দন পানি দিয়ে স্নান করা হয়। তারপর পাড়ার সকল বয়স্ক অর্থাৎ যারা বিবাহিত তাদেরকে তরুণ তরুণীরা মিলে স্নান করা হয়। এরপর সন্ধ্যায় মোমবাতি নিয়ে নদীকে পূজা করা হয়। এটি মূলত পুরানো বছরের সকল ময়লা, আবর্জনা মুছে নতুন বছরের মঙ্গল কামনা করা।
মৃত্যু ও শেষকার্য :
চাক সমাজে কারো মৃত্যু হলে বিশেষ ঢোল বাজায় যাতে মানুষ বোঝে কেউ মারা গেছে। গৃহস্থেরা খবর নেয়, গৃহিণীরা গৃহের সদর দরজায় একটি পাত্রে তুষ কিংবা আগরবাতি জ্বালিয়ে রাখে যাতে ভূত প্রেত না আসে। আবিগিং
(মামাতো ভাই) আসার পর মরদেহকে স্নান করানো হয়। ঘাট পারের ভাড়া হিসেবে মৃতের সাথে টাকা, পয়সা, থালা বাতি, কাপড়-চোপড় সবকিছু দিয়ে দেওয়া হয়। শবদেহটিকে আগুন কিংবা মাটি দেওয়ার পূর্বে ভান্তের উপস্থিতিতে মঙ্গলসূত্র ও পঞ্চশীল নেওয়া হয়। তারপর মৃতের বড় ছেলে কিংবা রক্তের সম্পর্কীয় আত্মীয় প্রথম চিতায় আগুন কিংবা মাটি দেয়। চাকরা দু ধরনের সৎকার করে থাকে।
১। আগুনে পুরা
২। মাটিতে পুতে ফেলা
কোন ব্যক্তি মৃতের আগে যেকোন কাউকে বলে যায়, মৃতের পর আমাকে আগুন দিও বললে আগুন দেওয়া হয়।
এটাই সংক্ষিপ্ত চাকদের জীবনধারা।
যদি কোন ভূল হয় তাহলে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাবেন এবং ক্ষমা করবেন।
Comments
Post a Comment