স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর নাড়াইছড়িবাসীদের সাথে এমপির সাক্ষাত।
দুর্গম পাহাড়ে অবস্থান করছি,অন -লাইনে সঠিক সময়ে আসতে না পারায় পাঠকদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী।কিছু কিছু ইতিহাস অতি বিরল।অসাধ্য সাধনের আগে কঠিনতর ইতিহাস বুনা কল্পনার বাইরে।কিন্তু স্বপ্ন যখন বাস্তবায়নে উপস্থিত, ঠিক তখনি খুশিতে আত্মহারা ছাড়া কিছু করার নেই।হ্যা, আমরা সেই হতভাগা দুর্গম পাহাড়ে ঝর্ণার কোল ঘেঁষে, কখনো পাহাড়ের চূড়ায় ছোট ছোট ম্যাচাঙ ঘরে বাস করা নরকীয়বাসী।যেখানে বিলাসবহুল মুক্ত বাতাসের হাওয়া দোলে, যেখানে মেঘেদের সাথে আড়াআড়িতেই হারিয়ে যাই সারাক্ষণ। প্রকৃতির সম্পদের তৃষ্ণায় আমাদের জীবন সংগ্রাম চলে।হ্যা, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম মানচিত্রের সর্বোত্তর ভূখন্ডের খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালা উপজেলার বাবুছড়া ইউনিয়নের দুর্গম নাড়াইছড়িবাসী।যেখানে ৫০০ পরিবারে শিশু জন্ম নেয়,কিন্তু শিশু অধিকার জন্মায় না ! যেখানে প্রসূতি 'মা' গর্ভধারণ করে, কিন্তু প্রসবের হাসপাতাল গড়ে না ! যেখানে ছোট -বড় রোগে মৃত্যুর মিছিল চলে,কিন্তু ডাক্তার জন্মায় না ! রাষ্ট্রের মৌলিক অধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন এই এলাকাটিকে জুম চাষীদের ছাড়া অন্য মানুষের হৃদয়ে ছিল খুবই অপরিচিত।
♦নাড়াইছড়ির বুকে বিরল ইতিহাস রচনায় বড় অবদান -বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের সম্মানিত আইনজীবী বাবুছড়া এলাকার একজন সু-পরিচিত ব্যক্তি স্যার - নিকোলাস চাকমার।দেখা নেই, সাক্ষাত নেই, অথচ বিশ্বাস ভরা হৃদয় দিয়ে স্যার নিকোলাস যেন আমার ভগবান। করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকটে ভরপুর নাড়াইছড়ি এলাকা।এলাকার একজন বাসিন্দা হয়ে গ্রামবাসীদের হাহাকার আমাকে কঠিনভাবে পীড়া দিচ্ছিল।কোন উপায় না পেয়ে পুরো এলাকাবাসীদর পক্ষ হয়ে গত ০৪/০৫/২০২০ ইং দিঘীনালা ইউএনও বরাবর নাড়াইছড়ি খাদ্য সংকট নিরসনের জন্য একটি দরখাস্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রদান করি। খুব অল্প সময়ে সকল শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগীতায় দ্রুত ভাইরাল হতে থাকে দরখাস্তটি।
কি এমন টানে, সেই দরখাস্তটি দ্বারা স্যার -নিকোলাস যেন আমায় আপন করে নেবার সুযোগ দেন।মেসেঞ্জারে নক করতেই ফোন নাম্বার বিনিময় হলে ডুবে যেতে থাকি বিভিন্ন কথোপকথনে। মহামারি দুর্যোগে নাড়াইছড়ির কষ্টের অনুভূতির গল্পগুলো আন্দোলিত থাকে স্যারের সাথে ফোন আলাপে। সারা নাড়াইছড়িবাসীদের হয়ে একজন জাত প্রেমিক - স্যার নিকোলাস চাকমার কাছে কাঁদতে থাকি।আমার অশ্রুতার অনুভূতিতে ডুবে স্যারের চেষ্টার কমতি ছিল না, আমাদের পাশে দাঁড়ানোর। দু-তিন দিন পর বর্তমান করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় পার্বত্যাঞ্চলে গড়ে উঠা " CHT Covid-19 Emergency Aid Committee( CCEAC)
সংস্থার পক্ষ হয়ে স্যার নিকোলাস আমাকে আশ্বাস দেন তিনি দুর্গম নাড়াইছড়ির গরিব ১০৬ পরিবারের পাশে দাঁড়াবেন। যেন খুশিতেই চোখের অশ্রু ঝরে।
♦আমি ঐ নাড়েছুড়ি কুকিছড়া বর- মোন জুম চাগালা থেকে আর নিকোলাস স্যার খাগড়াছড়ি নগর থেকে মুঠোফোনেঃ-
ফোন আলাপে নিকোলাস স্যার প্রস্তাব রাখেন , " উপহার প্রদান সভায় - তিন পার্বত্য জেলার (খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান) সংরক্ষিত মহিলা আসনের মাননীয় এমপি - বাসন্তী চাকমা প্রধান অতিথি হয়ে উপস্থিত থাকবেন।অতি খুশিতেই এমন সংবাদে বুকের বাম পাশ তখন কেমন জানি করছিল। হায় রে হতভাগা নাড়াইছড়ি ! কি রুপ নিয়ে জন্ম তোমার? তোমাকে চিনতো না। আজ বুঝি ছোট্ট ছোট্ট কল্পনাগুলি বাস্তবায়ন হতে চলেছে। যে নাড়াইছড়ির বুকে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পা পড়ে না, সেই নাড়াইছড়িতে এমপির পা! ভাবা যায়?দেশ স্বাধীনতার আজ ৪৯ বছর পর আজ নাড়াইছড়িতে এক বিরল নতুন ইতিহাসের জন্ম।দুর্গম নাড়াইছড়িবাসীদের কোমল হৃদয়ে আজ এমপির সাক্ষাত হবে ! যে নাড়াইছড়ির নাম শুনলে কেউ আমলে নিতো না, যে নাড়াইছড়ির পরিচয় দিলে অনেকে মসকারি করে উড়িয়ে দিত " ম মনান নাড়েছুড়ি ডেপ্পোছুড়ি গরের "। আজ সেই নাড়াইছড়ি দুঃখী মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে দিবেন মাননীয় এমপি -বাসন্তী। স্কুল জীবনে অনেকে আমায় হাসা-হাসি করতো। বলতো -" উইয়ো এজের নাড়েছুড়ি বান্দর'র গুয়ো পানি হেয়ি হিলোছেড়ে মানুচ্চু"। নানান মসকারি বাক্য দিয়ে আমাকে অনেকে উপহাস করতো। জন্মস্থান আমার - মহালছড়ি উপজেলার মাইসছড়ির করল্যাছড়ি গ্রামে, শৈশব - বেড়ে উঠা আমার নাড়াইছড়ির জুম পাহাড়ে।হ্যা, আমি নাড়াইছড়ির ধন,সম্পদ, রক্ত,ঘাম দিয়ে গড়া এক অভাগা সন্তান। স্বপ্ন দেখতাম, সকলের হৃদয়ে নাড়াইছড়িকে ফুটিয়ে তুলবো বিভিন্নভাবে। তাহলে কি আজ সেই ক্ষণ উপস্থিত? কিছু স্বপ্ন বাস্তবায়নে চাই সহযোগীতা, চাই অনুপ্রেরণা, চাই মনোবল, চাই পরামর্শ, চাই সাপোর্ট ইত্যাদি। আজ নিকোলাস স্যার যেন আমারি সব।নিকোলাস স্যারের সাথে সব কিছু আলোচনা শেষ করে সভার
"এমপি " শব্দটির সাথে নগরবাসীদের ঘনিষ্ঠতা থাকলেও মাইল থেকে মাইল দূরে অপরিচিত ছিল নাড়াইছড়ি পাহাড়িদের।এই দুটি অক্ষর দ্বারা কি বুঝানো হয়? উত্তর জানা নেই নাড়াইছড়ি এলাকার ৮৫% মানুষের।সারা বিশ্বে মহামারি "করোনা ভাইরাস" অনেকের কাছে অভিশাপ হয়ে জন্ম নিলে ও নাড়াইছড়িবাসীদের জন্য বড় আশীর্বাদ হয়ে জন্ম নিয়েছে।যেখানে উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছানো অগ্রিম শত বছর হিসাবে চলে আসে সেখানে এমপির সাক্ষাত বহু সাধনা,বহু প্রতিক্ষার বাইরে। জানি না, আজ কিভাবে, কোন পূণ্য দানের ফলে এমন মহৎ কার্য সম্পাদন হয়েছে।করোনা পরিস্থিতি আজ শত বছর পরের কঠিন কাজটি যেন সহজেই সফল করে দিয়েছে।জানা নেই -- আরো কত বছর পরেই,কার আমলে,কার উদ্দ্যােগে,কার পরিকল্পনায় নাড়াইছড়িবাসীরা এমপির সাক্ষাত পাবেন।আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাত পায় নি,আমরা বলতে পারিনি নিজেদের দুঃখ, কষ্টের অনুভূতির কথা।কিন্তু আজ আমাদের মাঝে এমন একজন উপস্থিত হবেন যিনি ঐ পাহাড়ের ভাজে গড়ে উঠা ঝর্ণা ধারার দুঃখ, কষ্টের অনুভূতিগুলো হৃদয়ে অবলোকন করবেন।যার চেহারায় পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রুপ খুঁজে পায়।তিনি আর কেউ নন, তিনিই আমাদের মাননীয় মহিলা এমপি " বাসন্তী চাকমা"।
♦ ১৮-০৫-২০২০ ইং রোজ সোমবার। তিনি আসবেন......
গতকাল ১৭ ই মে নাড়াইছড়ির গরিব মেহনতি মানুষদের নিয়ে অনিল জীবন কার্বারী পাড়ায় এক বিশাল গণ সমাবেশের ডাক দিই।
দলে- দলে জুমের শত কাজ বকেয়া রেখে তারা শুনতে এসেছিল " কে আসবে? কি নাম তার? কি তার পরিচয়? তার মুখের বাণী কিরুপ? ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে। নেতা নই,বয়স মাত্র ২২ কি ২৩, গণ সমাবেশের কোন্ডলে আমিই সবচেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ হই। উপস্থাপনার স্বাগত বক্তব্যে বাতাসের মৃদু শব্দ,পাখির কলকাকলি ও আমার কন্ঠের আওয়াজ সহ সারা সমাবেশ যেন নিবির।একের পর এক গুছালোভাবে হতভাগা দুর্গম পাহাড়ের এই জন সাধারণের কাছে ফুটিয়ে তুলে দিলাম এমপির রস। উৎসুক জনতার হাত তালিতেই প্রকাশ পায়, যেন তারা ত্রাণ উপহারের জন্য নয় - তারা আগামীকাল ২৫-৩০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যাবে এমপি দেখতে! এমপির কথা শুনতে! রাত পেরিয়ে ভোর ৪ টায় এক গ্রুপ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে ২৫-৩০ কিলো পথ পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম ধনপাতার উদ্দেশ্যে। সকাল ৭ টায় গন্তব্যে পৌঁছালে মঞ্চ সেজে উঠলো আমার নেতৃত্বে। সবকিছু প্রস্তুতি সম্পন্ন,তবুও কি যেন বাকী থেকে যায়! অপেক্ষায় শত জনতা, এমপির উদ্দেশ্য। ১৮-০৫-২০২০ ইং সকাল ১০ টার দিকে এমপির পা পড়লো ধনপাতার বুকে।
চোখের সামনে শত জনতা, তারা নয় কোন ভদ্র মেহমান লোক,নয় কোন জটিল স্বভাবের মানুষ।মাননীয় এমপি - বাসন্তী চাকমার সাথে এসেছিলেন এডভোকেট স্যার নিকোলাস চাকমা, বাবুছড়া ইউপি চেয়ারম্যান বাবু- সন্তোষজীবন চাকমা,বাবুছড়া ইউপির প্রাক্তন চেয়ারম্যান বাবু- পরিতোষ চাকমা, খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সহ প্রমুখ।অতিথিবৃন্দদের একে একে আসন গ্রহণের পর আনুষ্ঠানিকভাবে সভাটির সূচনা ঘটে। অতিথিদের বক্তব্য প্রদানের একের পর এক শেষ হতেই মাননীয় মহিলা এমপি- বাসন্তী চাকমা বর্তমান পরিস্থিতি ও নাড়াইছড়ির দুর্গম এলাকা নিয়ে শত জনতার মাঝে বক্তব্য প্রদান করেছেন।তিনি বিভিন্ন সহযোগীতার আশ্বাস দিয়ে সর্বদা পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিভিন্ন দিক নির্দেশনা ও পরামর্শমূলক বক্তব্য শুনে মোহিত নাড়াইছড়িবাসীরা।আমরা সেদিন পেয়েছিলাম দুঃখের সময়ে একজন মমতাময়ী মাতা।আমরা সেদিন দেখেছিলাম এমপির চেহারায় শুধু শাসন থাকে না, ভালোবাসা দিয়ে সাধারণদের কাছে টানার মায়াবী রুপ ও থাকে।দেশ স্বাধীনতার ৪৯ বছরের স্বার্থকতার দিন হইতো নাড়াইছড়িবাসীদের জন্য এটিই। চিরকাল ধরে নাড়াইছড়িবাসীদের হৃদয়ে গেঁথে থাকবেন মাননীয় লেডি এমপি -বাসন্তী চাকমা।তাদের কাছে সময়,সুযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শত ব্যস্থতার মাঝে আমাদের জন্য এমন একটি দিন উপহার দেওয়াতে আমরা অত্যন্ত খুশি ও কৃতজ্ঞ।
মাননীয় এমপি স্বল্প সময়ে আমাদের অনেক কিছু দিয়েছিলেন,বিনিময়ে আমরা শুধু হৃদয়ের ভালোবাসা দিতে পেরেছি। লিখতে লিখতে অনেকদূর এগিয়ে যায় কলম... তবুও শেষ হয় না হৃদয়ের জাগরিত কথাগুলো। যাক, শেষে মাননীয় লেডি এমপি - বাসন্তী চাকমা, মাননীয় এডভোকেট- নিকোলাস চাকমা,সু-পরিচিত সহযোগী সংস্থা -CCEAC ও বিভিন্নভাবে সহযোগীবৃন্দদের প্রতি সমগ্র নাড়াইছড়িবাসীদের পক্ষ থেকে হাজার নমষ্কার, শ্রদ্ধা,কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। সবাই ভালো থাকুন,সুস্থ থাকুন......
ধন্যবাদান্তে
অনন্ত চাকমা
১৮/০৫/২০২০ ইং।
(নাড়াইছড়িবাসীদের পক্ষ থেকে)
Comments
Post a Comment