প্রসঙ্গ জাতীয়তাবাদঃ তুষার শুভ্র তুলু

ত্রিপুরাদের একটি অংশ " জুম্ম জাতীয়তাবাদ" এর নামকরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সরাসরি না বললেও প্রকারান্তরে তারা জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে "চাকমা আন্দোলন" বলছেন অথবা জুম্ম জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলিতে ( UPDF, JSS) চাকমাদের সংখ্যাধিক্য দেখিয়ে ( প্রায় ৮০%) এই আন্দোলনকে "চাকমা আধিপত্যবাদী আন্দোলন" বলছেন।
আমি বিনয়ের সাথে বলছি আমি ঠিক নিশ্চিত নই উনাদের আপত্তি ঠিক কোন জায়গায়। "জুম্ম জাতীয়তাবাদ নামকরণে" নাকি "অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি জাতিগোষ্ঠীগুলির ঐক্যবদ্ধ জীবণ মরণ সংগ্রামে" তা সে যে নামেই হোক।

ছবিঃ'জুম্ম জাতীয়তাবাদ'পেইজ থেকে নেওয়া।

যদি "জুম্ম" শব্দটিতে আপত্তি থেকে থাকে তবে বিকল্প ভাবা যেতে পারতো এবং সেভাবেই প্রস্তাব উত্থাপিত হতে পারতো। যে শব্দ সকলের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায় না, নিঃসন্দেহে কোন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শের নামকরণ সেই শব্দে হতে পারে না।
আর জুম্ম জাতীয়তাবাদী দলগুলিতে (UPDF, JSS) কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে একদম নিচের স্তরে চাকমা বাদে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলির অংশীদারিত্ব কিভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে মতামত ও প্রস্তাব আসতে পারতো।কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনা ঠিক এই মুহুর্তে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে "চাকমা আধিপত্যবাদী" আখ্যায়িত করে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কেন? আমি বলছি না ব্যক্তি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে সমালোচনা করা যাবে না। কিন্তু তিনি আমাদের "আইকন"। আমাদের সকলের প্রেরণার উৎস। আমাদের সকল আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্তরূপ। আমাদের সকলের ঐক্যের প্রতীক। চরম দুঃসময়ে আমরা তার কাছে ছুটে যাই। আমি বিনয়ের সাথে বলতে চাই আমাদের এই " আইকনিক ফিগার" কে প্রশ্নবিদ্ধ করার এটাই কি উপযুক্ত সময়? আমি অনুরোধ জানাব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ আমার এই প্রশ্নের যেন উত্তর দেন।
আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনা ঠিক এই সময়ে ইসলামিক সম্প্রসারণবাদী এবং শাসকগোষ্ঠীর সাথে সুর মিলিয়ে চাকমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যের উপর আঘাত করে চাকমাদের উত্তেজিত করার প্রচেষ্টা কেন? এর একটাই কারণ হতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল আদি জাতিগোষ্ঠীগুলির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম নস্যাতের ইতিহাসের দায় এড়ানো।
বিষয়টি আরও ভালোভাবে বুঝতে হলে আমাদের উত্তর-পূর্ব ভারতের এবং সংলগ্ন উত্তর-পশ্চিম মায়ানমারের রাজনৈতিক প্রবণতার দিকে তাকাতে হবে।
ভারত বিশেষত মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর চীনের সাথে "Great Power Competition" এর প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তার অস্থিতিশীল এবং স্পর্শকাতর অঞ্চল উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করার জন্য এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো "Naga Insurgency" সমস্যাটি আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর ফলে নাগাদের বৃহত্তর রাজনৈতিক অধিকারসহ একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি গঠনের সম্ভাবনা উজ্জল হয়ে উঠে। অনুভূমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীগুলির রাজনৈতিক আধিকার আন্দোলনে বিশেষত ত্রিপুরা রাজ্যে "ত্রিপুরা ল্যান্ড" আন্দোলন বেশ জোরদার হয়।
উত্তর-পূর্ব ভারতের জাতিগুলির রাজনৈতিক আন্দোলনগুলির (সশস্ত্র কিংবা গণতান্ত্রিক) একটা সাধারণ প্রবণতা আছে। প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীই তাদের পূর্ব পুরুষদের আবাসভূমি হিসেবে একটি নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে তাদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালায়। পূর্ব পুরুষদের আবাসভূমি হিসেবে চিহ্নিত অঞ্চলে তারা অন্য কোন জাতিগোষ্ঠীর অবস্থান মেনে নিতে একেবারেই নারাজ। যেহেতু এই জাতিগুলি ৩/৪ পুরুষ আগেও আধা যাযাবর জীবনযাপন করতেন( জুম চাষের জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর আবাসস্থল পরিবর্তন অর্থে) তাই পূর্ব পুরুষের আবাসভূমি হিসেবে দাবীকৃত অঞ্চলগুলি প্রায়ই একে অন্যের সীমানা অতিক্রম করে। আর এটিই এ অঞ্চলের জাতিগুলির নিরবচ্ছিন্ন শত্রুতা এবং এই অঞ্চলে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের স্বার্থে বৃহত্তর ঐক্য প্রচেষ্টার প্রদান বাঁধা।

এই ধরণের রাজনৈতিক প্রবণতা আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষিত ত্রিপুরাদের একাংশের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষত উত্তরাংশকে তারা ত্রিপুরা জাতীয়তাবাদের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই দেখছেন। বাস্তবিক অধুনা সংকুচিত ত্রিপুরা রাজ্যটি ত্রিপুরা জাতির ঐতিহাসিক আবাসস্থলের ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র। ত্রিপুরা রাজ্যের বাইরে ত্রিপুরাদের ঐতিহাসিক আবাসস্থল ফেণী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, মৌলভীবাজার, মেঘালয়, আসাম( আসামের বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই) ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থান কিংবা জাতীয় চেতনা কোনভাবেই রাজনৈতিক ভাবে সংঘটিত হওয়ার পক্ষে অনুকূল নয়, শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম বাদে। আমি শিক্ষিত ত্রিপুরাদের একাংশের এই প্রবণতাকে কোনভাবেই বিচ্ছিন্নভাবে দেখতে রাজি নই। কারণ তারা মেধাবী এবং তাদের চিন্তা চেতনা দিয়ে তারা তাদের জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন।
যদি আমার ধারণা সত্য হয় তা হলে আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষিত ত্রিপুরাদের একাংশের এই চিন্তাকে "Dangerous and Unwise Political Adventure " হিসেবে গণ্য করি যা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি জাতিগোষ্ঠীগুলির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মূলে কুঠারাঘাত করবে।

আমি উনাদেরকে বিনয়ের সাথে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই রাষ্ট্রীয় সীমানা অবশ্যম্ভাবীভাবেই অনিবার্য কিছু রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করে। সিরিয়া, ইরান, ইরাক, তুরস্ক চারটি রাষ্ট্রে বিভক্ত কুর্দিদের অধিকার আদায়ের রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনার ধরণগুলো সেখানেই পরিষ্কার হয়।

ত্রিপুরা জাতীয়তাবাদের অবশ্যই ঐতিহাসিক ব্যপ্তি এবং প্রেক্ষাপট রয়েছে। ত্রিপুরা জাতির ইতিহাস পড়লে চমকিত হতে হয়। কি নেই সেখানে! সমৃদ্ধ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনী, মিথ, বীরদের বীরত্ব, বীরঙ্গনাদের কাহিনী, মহান সব রাজা মহারাজা, দুর্ধর্ষ সব সেনানায়ক। কিন্তু তা সত্ত্বেও বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে একদা প্রাচীন এক সমৃদ্ধ এই জাতির রাষ্ট্র শক্তিগুলোর এবং শক্তিশালী অপর সংস্কৃতিগুলির আগ্রাসনের মুখে আত্মরক্ষার কোন শক্তিকেন্দ্র নেই।

দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি ত্রিপুরায় কোন মহারাজা জাতিগঠনের কাজটি করেন নি। একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক স্বত্ত্বা হিসেবে রুশদের যাত্রা শুরু হয় ৮৮২ খ্রিস্টাব্দে, ইতিহাসে যারা 'কিয়েভান রুশ' নামে পরিচিত। ষোড়শ শতাব্দীতে "আইভান দি টেরিবল" এর সময়ও রাশিয়া ছিল একটি ক্ষুদ্র প্রিন্সিপিলিটি মাত্র। আইভান দি টেবিলের সময় রাশিয়ান সম্রাজ্যের বিস্তার শুরু হয়। তারপর একে একে "পিটার দি গ্রেট", "সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিনা", জারনিকোলাস-১" কিংবা হালের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন" প্রত্যেকেই রাশিয়াকে একটি বিশ্বশক্তিতে পরিণত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং চালিয়ে যাচ্ছেন। বিজিত অঞ্চলগুলিতে রাশিয়ান সম্রাটগন রাশিয়ান ভাষাভাষী মানুষদের পুনর্বাসন করতেন। অথচ ত্রিপুরার ক্ষেত্রে হয়েছে ঠিক তার উল্টা। যেমন স্বয়ং মহারাজা রত্ন মানিক্য নিজ রাজ্যে ১০ হাজার বাঙালি পুনর্বাসিত করেছিলেন। জাতিগঠনের এই বিপরীত সিদ্ধান্তগুলির কারণে ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীদের বড় একটি অংশ বাঙালিদের সাথে মিশে যায় এবং ত্রিপুরা জাতি তাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহাসিক আবাসস্থলগুলি হারায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী আমরা প্রত্যেকেই বিলুপ্তির খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে, আমাদের ছোট্ট একটি রাজনৈতিক ভুল পদক্ষেপ ফেলারও কোন সুযোগ নেই। পারস্পারিক গভীর শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, সমম্বয়, বোঝাপড়া ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে সুদৃঢ় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই একমাত্র আমাদের বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে পারে। আমি ছোট্ট একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আলুটিলায় (আড়বাড়ি) ত্রিপুরাদের ভূমি রক্ষার আন্দোলনটি সফল হয়েছিল। দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন গুলি ঐক্যবদ্ধ এবং সম্মিলিত সংগ্রামের ফলে। বিনয়ের সাথে স্মরন করিয়ে দিতে চাই ত্রিপুরা বুদ্ধিজীবিগণ এটিকে শুধু মাত্র টি.এস.এফের সফলতা হিসেবে দেখেছেন। টি.এস.এফের সাবেক নেতা মুকুল ত্রিপুরাও তার লেখায় আলুটিলা (আড়বাড়ি) ভূমি রক্ষার আন্দোলনে অন্যান্য রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠনগুলির অবদানের বিষয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেন নি। আমি কোন ভাবেই টি.এস.এফের ভূমিকে খাটো করে দেখছি না। পার্বত্য চট্টগ্রামে যতগুলো সংগঠন আছে তার মধ্যে টি.এস.এফকেই আমি সবচেয়ে সুসংগঠিত, স্বয়ংক্রিয় এবং গতিশীল মনে করি। কিন্তু তারপরও সচেতন ব্যক্তি মাত্রই স্বীকার করবেন শুধুমাত্র টি.এস.এফের পক্ষে এই আন্দোলন কোনভাবেই সফল করা সম্ভব ছিলো না।

পরিচিত অনেকেই এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক দলগুলির অনেকেই স্বয়ংক্রিয় নেতাকর্মী আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্তঃজাতিক সম্পর্কের এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে না লিখতে অনুরোধ করেছেন বা পরামর্শ দিয়েছেন। আমি মনে করি এটি একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক হঠকারিতা।

পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মজাতীয়তাবাদ এবং আন্তঃজাতিক সম্পর্কে ফাটল ধরেছে দিবালোকের মত পরিস্কার এই সত্যটি উনারা কিছুতেই বুঝতে চাচ্ছেন না বা স্বীকার করতে চাচ্ছেন না। সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে উল্টো উট পাখির মত বালিতে মুখ গুঁজে থাকলেই কি এই সমস্যার সমাধান হবে। বরং সমস্যাটিকে স্বীকার করে নিয়ে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধান করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি জাতিগোষ্ঠীগুলির ঐক্যবদ্ধ আজ চরম এক অচল অবস্থা এবং অন্ধ কানাগলিতে দাঁড়িয়ে। আর এ অনিবার্য ফলস্বরূপ "জুম্মজাতীয়তাবাদ " এবং আন্তঃজাতিক সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। অপ্রিয় হলেও তো সত্য পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক দলগুলির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং নীতি নির্ধারকগন অধিকাংশই চাকমা সম্প্রাদায়ের। আর অন্য জাতিগোষ্ঠীর চিন্তাশীল অংশটি দলগুলি রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুখের দিকে চেয়ে অনন্তকাল বসে থাকবেন না এটাই স্বাভাবিক। সময়ের প্রয়োজনে জাতিগুলি তাই নিজেদের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য সংগঠন গড়ে তুলেছেন এবং এইসব সংগঠনগুলি ক্রমবর্ধমান ভাবে প্রচ্ছন্ন কিন্তু জোরালো রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করছে যা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্র যোগ করেছে। এর মধ্যে ত্রিপুরাদের সংগঠনগুলি ব্যতিক্রম। কেননা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরেও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে ত্রিপুরাদের বিশাল সংখ্যাধিক্য রয়েছে৷
আর এই সবকিছুর মূলে আমি রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বের দুর্বলতা, রাজনৈতিক দলগুলির সংগঠন এবং পরিচালনার প্রক্রিয়াকে যুগোপযোগী না করা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার অভাব এবং সর্বোপরি শাসকগোষ্ঠীর পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের "স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপের বিপরীতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং দিক নির্দেশনা প্রদানের ব্যর্থতাকে দায়ী করব। বাস্তবিকপক্ষে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা পরবর্তী কোন রাজনৈতিক নেতাই নেতৃত্বে, রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার কাছাকাছি কোন অবস্থাতেই যেতে পারেন নি। বরঞ্চ গত দীর্ঘ দুই দশকেরও অধিক সময়ে একের পর এক ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম যেমন তার বৈপ্লবিক আবেদন হারিয়েছে তেমনি কৌশলগত ভাবেও একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়েছে।

আমি সকল রাজনৈতিক দলের কর্মীদের আন্তরিকভাবে আহ্ববান জানাব এই লেখার বিরুদ্ধে কলম ধরার আগে দয়া করে আপনারা একসময়কার জিউশ কমিউনিটির সভাপতি এবং ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী " ডেভিড বেন গুরিয়ন" এর জীবনী খুব ভালোভাবে পড়বেন। আর যদি পড়া থাকে তাহলে গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করবেন।
বলিষ্ঠ নেতৃত্বে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞায়, বিচক্ষণতায়, দূরদর্শিতায় এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিভাবে কার্যত অসম্ভব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে একটি জাতির রাজনৈতিক আকাঙ্খাকে বাস্তব রূপ দিতে হয় পৃথিবীর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে "ডেভিড বেন গুরিয়ন" এর মতো দৃষ্টান্ত আর কোন রাজনৈতিক নেতা দেখাতে পারেন নি। ইহুদিদের সশস্ত্র উপদলগুলি হাগান, পালমাক, ইরগুন কিংবা স্ট্যান্স গ্রুপকে যেভাবে তিনি পরিচালনা করতেন তা এককথায় অনবদ্য। তিনি ইহুদী সশস্ত্র দলগুলির বিশিষ্ট আরব ব্যক্তিত্ব কিংবা উচ্চ পদস্থ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের অনেকগুলি হত্যা পরিকল্পনা নাকচ করে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন এরফলে "জিউশ মুভমেন্ট" বিশেষত ইউরোপ ও আমেরিকায় তার আবেদন, সমর্থন হারাবে এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, সরকার ও রাষ্ট্রের সাথে জিউশ কমিউনিটির অপ্রয়োজনীয় বিরোধ তৈরি হবে।

ত্রিপুরা জাতি তাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহাসিক বিচরণভূমির বৃহত্তর অংশটি ইতিমধ্যে হারিয়ে ফেলেছেন। ত্রিপুরা রাজ্যের বাইরে শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছেন। ইতিমধ্যে ফেণী নদীর তীরবর্তী উর্বর অঞ্চলগুলি অনুপ্রবেশকারীদের দখলে গিয়েছে। অন্য কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলির সাথে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামেই কেবল ত্রিপুরা জাতি ত্রিপুরা রাজ্যের বাইরে তাদের পূর্বপুরুষদের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বিচরণভূমিটি রক্ষা করতে পারবেন। আর তাতে ব্যর্থ হলে ত্রিপুরা রাজ্যেও তাদের বৃহত্তর রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অনেকটাই শক্তি হারাবে৷
গত কয়েকদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্তঃজাতি সম্পর্কের ইস্যু নিয়ে এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক ইস্যুতে যে বাহাস চলছে তাতে নিজের, নিজেদের গায়ে থু থু ছিটাতে ইচ্ছে করে। আমি শত ধিক্কার জানাই আমাদের গোল্ডফিশ মেমোরি এবং বুদ্ধির জড়তা ও চিন্তার মূঢ়তাকে। অথচ এই আমরাই আশির দশক এবং নব্বই দশকের প্রথম দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত হওয়া বর্বরোচিত গণহত্যায় আমাদের কোন না কোন আপনজনকে হারিয়েছি। প্রতিদিন শত শত সুজাতা, তুমাচিং,  কৃত্তিকাদের আর্তচিৎকার চাপা পড়ে যাচ্ছে বুটের তলায়। সেখানে আমরা মেতে আছি ফেসবুকীয় বাহাসে।  এই বাহাসে আমরা কি কেউ জিতছি? না আমরা সবাই হারছি! আমরা সবাই হেরে যাচ্ছি, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ হেরে যাচ্ছে। 

 আমি খুবই হতাশ হয়েছি যুবকদের বড় একটি অংশের চিন্তার জড়ত্ব দেখে৷ তারা প্রশ্ন করতেই ভুলে গেছে। নতুন সবকিছু চিন্তা করতেই ভুলে গেছে। দীর্ঘ দুই দশকের দিশাহীন স্থবির রাজনীতি দেখেও তারা কেন এই ছোট্ট সহজ সত্য কথাটি বুঝার এবং বলার সাহস রাখে না যে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে অবশ্যই সমস্যা আছে৷ তারাই যদি প্রশ্ন করতে ভুলে যায়, নতুন কিছু ভাবতে ভুলে যায় তাহলে পরিবর্তন আসবে কিভাবে?
একসময় পদাতিক সৈন্যদের একটি যুদ্ধ কৌশল ছিল "Tortoise Formation".  এক্ষেত্রে একদল সৈন্য তাদের ঢালগুলি দলের সম্মুখভাগ, উপরিভাগ এবং পার্শ্বদেশে ঘনভাবে সন্নিবেশিত করে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার বেষ্টনী তৈরি করতো। আমাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম তা "জুম্মজাতীয়তাবাদ" বা অন্যান্য যে নামেই হোক আমাদের সেই নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী। এই নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙ্গে গেলে আমরা শত্রুদের প্রবল আক্রমণের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়বো এবং ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবো।  পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগোষ্ঠী গুলির সুদৃঢ় ঐক্যের বন্ধন রক্ষার দায় একক কোনো জাতি বা গোষ্ঠী নয় বরং তা সম্মিলিত ভাবে সকলের। 

সবশেষে অসমিয়া, গোর্খা, খুমী, খিয়াং, লুসাই, পাংখো, বম, চাক, মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা সকল জাতির তরুণ- তরুণীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনাদের কি মনে আছে 'Gladiator' ছবিতে নিষ্ঠুর আফ্রিকান রথারোহী যোদ্ধাদের মুখোমুখি হওয়ার আগে "General maximus" তার সঙ্গীদের কি বলেছিলেন?

তিনি তার সঙ্গীদের বলেছিলেন- 
"Whatever comes out of the gate.... we have better chance of survival if we work together. 
 
If we stay together, we will survive " 

হ্যাঁ সব ভাই-বোনদেরকে বলছি, 
If we want to survive, we must stay together.

Comments

Popular posts from this blog

আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র

আদিবাসী অধিকার কি,এগুলো কোথায় পাবো ?