পাহাড়ে রক্তপাত বন্ধ হোক"- ডঃ রাহমান নাসির উদ্দিন।



১৯৯৭ সালে যে বছর 'পার্বত্য চুক্তি' যা 'শান্তি চুক্তি' নামে বহুল পরিচিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়; সে বছর হুমায়ুন আজাদের একটি বই প্রকাশিত হয়, যা ছিল 'পার্বত্য চট্টগ্রাম :সবুজ পাহাড়ের ভেতর প্রবাহিত হিংসার ঝর্ণাধারা'। হুমায়ুন আজাদ সে সময় পাহাড়ি বনাম বাঙালি এবং শান্তিবাহিনী বনাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যকার যে বিরূপ সম্পর্ক, সেটিকে প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরের ২ তারিখে যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মধ্যে 'পার্বত্য চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয়, আমরা সবাই তখন আশা করেছিলাম এবার পাহাড়ের 'হিংসার ঝর্ণাধারা' বন্ধ হবে এবং শান্তির শ্বেত কপোত উড্ডয়ন করবে। কিন্তু তৎকালীন প্রতিপক্ষের মধ্যে 'হিংসার ঝর্ণাধারা' খানিকটা বন্ধ হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন নিজেদের মধ্যে নানান দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে নিজেরাই রক্তের খেলায় মেতে উঠতে শুরু করে। প্রকারান্তরে পাহাড়ে প্রত্যাশিত শান্তির পরিবর্তে পুনরায় খানিকটা অশান্তি বিরাজ করতে শুরু করে।

পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ২৩ বছর পরে এসেও যখন পাহাড়িদের রক্তে পার্বত্য অঞ্চলের মাটি রঞ্জিত হয়, তখন সহজেই উপলব্ধি করা যায়, পাহাড়ের 'হিংসার ঝর্ণাধারা' এখনও বন্ধ হয়নি। বরঞ্চ হিংসার ঝর্ণাধারা প্রতিপক্ষের রক্তপাতে পরিণত হয়েছে। গত ৮ জুলাই বান্দরবানের রাজবিলা ইউনিয়নের বাঘমারা বাজার এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে ছয়জন পাহাড়ি নিহত হওয়া, এ বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করে। ১৯৯৭ সালের 'পার্বত্য চুক্তি' স্বাক্ষরের পর থেকে যখনই কোনো পাহাড়ি আদিবাসীকে হত্যা করা হয়, তখনই তাকে 'ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত' কিংবা 'প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই' কিংবা 'পাহাড়ি রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তঃকলহের জের' হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এবারও তাই হয়েছে, কেননা পুলিশ বলেছে- 'আধিপত্য বিস্তারের জন্য এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।' আর স্থানীয়রা সব সময় এটাকে উপস্থাপন করে 'সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্য' এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এগুলো মোটামুটি একটা 'টাইপ' পেয়ে গেছে যে, যখনই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটবে, তখনই এটিকে 'চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস এবং আধিপত্য বিস্তারের' বয়ান দিয়ে একটি ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় এবং এবারও তাই হচ্ছে।

ঘটনার দায়-দায়িত্ব নিয়েও একটি কাঠামো ইতোমধ্যে খাড়া হয়ে গেছে যে, যখনই ইউপিডিএফের কোনো নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়, তখন সেটি তার প্রতিপক্ষ হিসেবে পিসিপি অথবা জেএসএসকে (সন্তু লারমা) দায়ী করা হয়। যখনই জেএসএসের (এমএন লারমা) কাউকে হত্যা করা হয়, তখনই জেএসএসকে (সন্তু লারমা) দায়ী করা হয়। আবার যখন জেএসএসের (সন্তু লারমা) কাউকে হত্যা করা হয়, তখনই সেখানে জেএসএসকে (এমএন লারমা) দায়ী করা হয়। এবারও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। যেহেতু যে ছয়জনকে হত্যা করা হয়েছে, তারা প্রত্যেকে জেএসএসের (এমএন লারমা) নেতাকর্মী, সেহেতু তারা এ হত্যাকাণ্ডের জন্য জেএসএসকে (সন্তু লারমা) দায়ী করছে। এবং সেটি খুবই স্বাভাবিক, কেননা পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতি জেএসএসের (এমএন লারমা) প্রতিপক্ষ হচ্ছে জেএসএস (সন্তু লারমা)। এ 'দায়ী করার সংস্কৃতি' বুঝতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি রাজনৈতিক দলগুলোর নানান দল-উপদলে বিভক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত উপলব্ধিটা জরুরি।

১৯৭৩ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস গঠিত হয়। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং গেরিলা যুদ্ধের শেষে একটি রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র যোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পণ করে শান্তিবাহিনী বিলুপ্ত ঘোষণা করলেও জেএসএস একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম গণতান্ত্রিক আন্দোলন জারি রাখে। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের বিরোধিতা করে একটি অংশ মূল দল থেকে বের হয়ে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ গঠন করে ১৯৯৭ সালেই। এরপর থেকেই মূলত জেএসএস এবং এর ছাত্র ফ্রন্ট পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) সঙ্গে ইউপিডিএফের নিয়মিত এবং অনিয়মিতভাবে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়। পরে ২০১০ সালে মূল দল জেএসএস থেকে একটি গ্রুপ বের হয়ে সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচয় দিয়ে জেএসএস (এমএন লারমা) গঠন করে। এবং এই জেএসএসকে (এমএন লারমা) সমর্থন দেয় ইউপিডিএফ। ফলে জেএসএস মূল দলটি হয়ে যায় জেএসএস (সন্তু লারমা) আর সংস্কারপন্থি দলটি হয়ে যায় জেএসএস (এমএন লারমা)। ২০১০ সালের পর থেকে চতুর্মুখী দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয় জেএসএস (সন্তু লারমা), জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ এবং পিসিপির মধ্যে। পরে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউপিডিএফ ভেঙে ইউডিপিএফ (গণতান্ত্রিক) নামকরণ করে নতুন একটি ফ্রন্ট তৈরি করা হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, ইউপিডিএফের একটি অংশ ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নাম ধারণ করে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন মূল দল জেএসএসের (সন্তু লারমা) সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ফলে চতুর্মুখী সংঘাত পঞ্চমুখী রূপ নেয়। এভাবেই পাহাড়ে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যকার ভাঙন এবং নানান দল ও উপদল মিলে নতুন করে 'হিংসার ঝর্ণাধারা' শুরু করে। যার ফলে পাহাড়ে নিয়মিত বিরতিতে রক্তপাতের ঘটনা ঘটে।

একটি হিসাব অনুযায়ী ১৯৯৭ সালের পর পাহাড়ি আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যকার নানান দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে প্রায় ৮০০ মানুষ নিহত হয়েছে। বান্দরবানের এই ছয়জনের মৃত্যু পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে সুদীর্ঘ মৃত্যুর মিছিলের সর্বশেষ সংযুক্তি। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যারা কমবেশি খোঁজ-খবর রাখেন, তারা জানেন জেএসএসের (সন্তু লারমা) একচ্ছত্র আধিপত্য আছে রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় এবং জেএসএসের (এমএন লারমা) একচ্ছত্র আধিপত্য আছে খাগড়াছড়িতে। বান্দরবান পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পার্বত্য জেলা হলেও এখানে জেএসএস (সন্তু লারমা) এবং জেএসএস (এমএন লারমা) কারোরই কোনো একচ্ছত্র আধিপত্য নেই। কিন্তু বান্দরবান কার বা কাদের দখলে যাবে তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রতিযোগিতা চলছে। বান্দরবানে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার অংশ হিসেবে উভয় পক্ষ যেমন সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেছে, তেমনি একে অন্যকে নির্মূল করার চেষ্টা করবে এটাও বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

তার মানে এই নয়- যে ছয়জনকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের জেএসএসের (সন্তু লারমা) লোকজন হত্যা করেছে। বিষয়টি এখনও তদন্ত সাপেক্ষ এবং আমরা আশা করি, এ হত্যাকাণ্ডের যথাযথ তদন্ত হবে এবং প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পাবে। যদি তর্কের খাতিরে ধরেই নিই যে, অন্য কোনো পাহাড়ি প্রতিপক্ষ বা উপদল এই ছয়জন পাহাড়িকে হত্যা করেছে, তাহলে এ হত্যা প্রকারন্তরে কারও কোনো দীর্ঘমেয়াদি লাভ বয়ে আনছে কিনা তা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করতে হবে।

যে কোনো হত্যাই নিন্দনীয়। পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর নানান উপদল যদি নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত জিইয়ে রাখে, তাহলে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তর জনগণের জীবনে কোনোদিনই শান্তি আসবে না। আর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যদি কোনো দৃশ্যমান এবং গ্রহণযোগ্য উন্নতি না ঘটে, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অধিকতর উপস্থিতির ন্যায্যতা তৈরি করে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- যদি পাহাড়ের রাজনীতি হয় পাহাড়িদের কল্যাণ সাধন করা, তাহলে হত্যার রাজনীতি কোনোদিন কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। নিজেদের মধ্যে নানান মতপার্থক্য থাকতে পারে, তবে কোনো একটি বা দুটি ইস্যুতে পাহাড়িদের বৃহত্তর কল্যাণে পাহাড়ি আঞ্চলিক দল-উপদলগুলো যদি একটি সমন্বিত এবং সমঝোতার প্ল্যাটফর্মে আসতে পারে, তাহলে পাহাড়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিবেশ অনেকটাই দূরীভূত হবে এবং বাঙালি-পাহাড়ি উভয়ের মধ্যেই একধরনের আস্থার পরিবেশ তৈরি হবে।

সবাই শান্তি চায়, তবে নিজেদের মধ্যে সংঘাত অব্যাহত থাকলে অশান্তি এসেই শান্তির জায়গা দখলে নেবে। আমরা চাই পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ২৩ বছর পরে এসে হলেও এ চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হোক। পাহাড়ে সব ধরনের রক্তপাত বন্ধ হোক। শান্তির ফল্কগ্দুধারা প্রবাহিত হোক।

অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

Popular posts from this blog

আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র