আদিবাসী গারো নারী ফুটবলার মারিয়া মান্দার কথা ।। ধীরেশ চিরান
প্রকাশিত :সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২০
মারিয়া মান্দার ফুটবলে হাতে খড়ি হয় ধোবাউড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কলসিন্দুর সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। মারিয়া মান্দা নিজের গ্রাম মন্দিরঘোনা থেকে তৃতীয় শ্রেণি পাশ করে পাশের গ্রাম কলসিন্দুর সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ২০০৯ সালে ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। মারিয়া মান্দা অতি সাধারণ গারো পরিবারের মেয়ে। এই জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহে বেশি বসবাস করে। এছাড়া টাঙ্গাইল, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, গাজিপুর, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও বসবাস এবং বিচরণ রয়েছে গারোদের।
বাংলাদেশে বর্তমানে গারোদের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত রয়েছে। তবে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে আদম শুমারীতে বাংলাদেশে গারোদের সংখ্যা ২৬০,০০০ উল্লেখ করেছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ২০১১ খ্রিস্টাব্দের আদম শুমারী অনুসারে গারোদের সংখ্যা ১,১০৩,১১৫ জন । মারিয়া মান্দা এই গারো জন গোষ্ঠীরই একজন সদস্য।
মারিয়ার জ্ঞান হওয়ার আগেই বাবা বীরেন্দ্র ম্রং চলে গেছেন না ফেরার দেশে। মা এনাতো মান্দা চার সন্তানকে নিয়ে সংসার সামলাতে অথৈ সাগরে পড়ে। চার ভাই বোনদের মধ্যে মারিয়ার স্থান তৃতীয়। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে ধাইরপাড়া গ্রামে। মায়ের সাথে সংসারের ঘানি টানতে টানতে মারিয়ার ইমিডিয়েট বড় বোন পাপিয়ার আর লেখাপড়া তেমন হল না। মারিয়ার ছোট ভাই পড়ে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। কিন্তু মা এনাতো মান্দা দমে থাকার পাত্র নয়। তার যত কষ্টই হউক ছেলে মেয়েদেরকে লেখাপড়া করাবেই। সংসার চালানোর জন্য এনাতো মান্দাকে অন্যের জমিতে কাজ করতে হয়েছে। ছেলে মেয়েদের মুখে দুমুঠো খাবার তোলে দেওয়ার জন্য মা এনাতো মান্দাকে অন্যের বাড়িতেও গৃহপরিচারিকার কাজ করতে হয়েছে। রাস্তায় মাটি কেটে সংসার চালাতে হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে খেলার সময়ও মার সাথে সাথে মারিয়াকেও অন্যের বাড়িতে ও ক্ষেতে কাজ করতে হয়েছে।
মারিয়া মান্দা কলসিন্দুর প্রাইমারি স্কুলে ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে স্কুলের মেয়েদের ফুটবল টিমে খেলার সুযোগ পায়। ছোট বেলা থেকে মারিয়ার খেলাধুলার প্রতি বেশ ঝোঁক ছিল। ছোট বেলায় পুতুল খেলার পাশাপাশি গোল্লাছুট, কানামাছি, দাড়িয়াবান্দা, কুট কুট থেকে ষোলগুটি, লডু, ঘিলা, তাপ্পি ও পুল্লো খেলত। নদীতে যখন তখন দৌড় ঝাপসহ সাঁতারও তার বেশ আকর্ষণ ছিল। তাছাড়া গ্রামের আট দশটা মেয়ের মত গাছে চড়াসহ দোলনায় দোলা তার বেশ পছন্দ ছিল। তবে তখন ফুটবল খেলত না। প্রথমে আন্তঃস্কুল পর্যায়ে খেলা। এর পর জাতীয় পর্যায়ে বঙ্গমাতা গোল্ড কাপে অংশগ্রহণ। দুই হাজার এগারো-বারোতে তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেনি মারিয়ার কলসিন্দুর স্কুল।
তৃতীয়বারে ২০১৩ সালে মারিয়ার কলসিন্দুর সরকারি প্রাইমারি স্কুল বঙ্গমাতা গোল্ড কাপ চ্যাম্পিয়ান হয়ে সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। খেলায় তার দৃষ্টি নন্দন ক্রীড়াশৈলী পায়ের কারুকার্যে মধ্যমাঠে মুগদ্ধতা ছড়াতে জুড়ি নেই। তার খেলার ধরণ পেশাদার ফুটবলারদের মতই হয়ে উঠে। অতঃপর ২০১৪ সালেই মারিয়া মান্দা অনূর্ধ-১৪ জাতীয় দলে ডাক পায় এবং পরে অধিনায়ক। মারিয়া মান্দা এখন শুধু অধিনায়কই নয়, বাংলার নারী ফুটবল অঙ্গণে একটি প্রতিভার নাম।
২০১৫ সালে সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ানশিপে কাঠমন্ডুতে নেপাল বধের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটে মারিয়ার ক্যারিয়ার। মারিয়ার নেতৃত্বে ২০১৫ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়ানশিপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ান হয়ে নেপালের রাজধানী কাঠমন্ডুতে ফাইনালে নেপালকে পরাজিত করে সাফ অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়ানশিপ কাপ জিতে নেয় মারিয়ার লাল সবুজের বাংলাদেশ। বদলাতে থাকে মারিয়ার পৃথিবী। ২০১৬ এবং ২০১৭ সাফ চ্যাম্পিয়ানশিপে ও এশিয়ার মধ্যাঞ্চলেও সেরা দল হিসেবে চ্যাম্পিয়ান হয় মারিয়ার বাংলাদেশ।
২০১৭ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়ানশিপে ঘরের মাঠে মারিয়ার অধিনায়কত্বে দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলে পরাশক্তি ভারতকে সেমিফাইনালে ৩-০ এবং ফাইনালে ১-০ গোলে দুই দুইবার হারিয়ে চ্যাম্পিয়ান হয় বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার বয়সভিত্তিক নারী ফুটবলে বাংলাদেশ পরাশক্তি হিসেবেই দেখা দেয়।
২০১৮ সালটা বাংলার অনূর্ধ্ব-১৬ বিশ্বকাপ এশিয়ার গ্রুপ পর্যায়ে বাছাই পর্বে মারিয়াদের জন্য স্বর্ণযুগ বলা যায়। অনূর্ধ্ব-১৬ নারী বিশ্বকাপে বাছাই পর্বে খেলার জন্য এশিয়ার গ্রুপ পর্বে বাংলার মারিয়া মান্দার দল অপরাজিত চ্যাম্পিয়ান হয়। চার খেলায় মারিয়ার দল সর্বোচ্চ ২৭টি গোল করে এশিয়ার বাছাই ও গ্রুপ পর্বে এশিয়ায় নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে। এর পূর্বে ভিয়েতনাম ২৫টি গোল করে এশিয়ার সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড করেছিল। এই রেকর্ড ভেঙে এখন মারিয়াদের দখলে। এখন মারিয়ার বাংলাদেশ এএফসি বাছাই পর্বের সরাসরি চূড়ান্ত পর্বে খেলবে।
এএফসি বাছাই পর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ান হয়ে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন উড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে মারিয়া তার লেখনীতে বলেছেন ‘‘আমি স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশের মেয়েরা একদিন ফুটবলে বিশ্বকাপের জন্য লড়বে। আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা হয়েছি। এএফসি কাপে চ্যাম্পিয়ান হয়ে আসিয়ান, এশিয়ার মধ্যাঞ্চলের দেশগুলোকেও চেলেঞ্জ জানিয়েছি। দেখিয়ে দিয়েছি বয়স ভিত্তিক ফুটবলে আমরাই এই অঞ্চলে সেরা। এখন আমাদের লক্ষ্য বিশ্বকাপে খেলা। আমরা বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়ার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’’
ইতোমধ্যে মারিয়া মান্দা নারী ফুটবলে বিশেষ অবদান রাখার জন্য অনন্যা শীর্ষদশ সন্মাননা ২০১৭ লাভ করেছেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ খ্রিস্টান এসোসিয়েশনের ৫০ বছর সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব উপলক্ষ্যে খ্রিস্টান সমাজে বিভিন্ন কাজে বিশেষ অবদান রাখার জন্য প্রদত্ত শীর্ষ ৮ গারো গুণি ব্যক্তি সন্মাননাও লাভ করেছেন। এখন মারিয়াদের একটাই স্বপ্ন এশিয়া অঞ্চলে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে নিজের সেরাটা খেলে চূড়ান্ত পর্বে খেলা।
লেখক পরিচিতি
গারো সম্প্রদায়ের লেখক ধীরেশ চিরান গল্প-উপন্যাস নয় লিখতে পছন্দ করেন গবেষণাধর্মী কিংবা ইতিহাস বিষয়ক লেখা। ২০১৯ সালের বই মেলাতে ধীরেশ চিরানের গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘ বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিপন্ন প্রায় পাহাড়ি নদ নদীর কথা’ প্রকাশিত হয়েছিলো থকবিরিম প্রকাশনী থেকে। সেই গ্রন্থ-ই ধীরেশ চিরানকে সবার কাছে পরিচিতি এনে দেয়। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসরত একশ গুণি গারো ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করছেন। সামনে ২০২১ সালের বই মেলায় গারো নারী ফুটবলার মারিয়া মান্দাকে নিয়ে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ প্রকাশ হতে যাচ্ছে। ধীরেশ চিরানের নতুন গ্রন্থের নাম ‘ মায়িা মান্দা; গারো নারী ফুটবলের পথিকৃত’
Comments
Post a Comment